প্রবন্ধ...
কোমরে বড্ড ব্যথা
রে, মোদী গদি হাঁকড়ে সেকুলার জমিতে হিন্দুধ্বজা ঘচাং, সারদা-কাণ্ডের পর ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে সতেরো টাকার বেশি স্বপ্ন বয়ন ব্যান দর্শনমুখর দ্বিপ্রহরে উচ্চব্রেনে গাম্বা প্রবলেম-রাশি চিড়িক-শক ছড়াচ্ছে, হঠাত্‌ ছিঁচকে কোশ্চেন-মার্ক ফোটাল কোন মুরুখ্যু: বিদ্বজ্জনেরা কামদুনি গেলেন না কেন? আ মোলো, তাঁদের কাজ নেই? যেখানে দেখিবে ক্রাইম খসাইবে তব টাইম, এ পলিসিতে পড়তায় পোষাবে? পুজোসংখ্যার নভেল নেই? কোব্তে? সিডি-র জন্যে গান? ক্যানভাসে পোঁচ? প্রতিবাদটা তো তাঁদের ফুলটাইম পেশা নয় রে বাপ। তার ওপর যে রেটে ধর্ষণ হচ্ছে, তাতে সবক’টা সাইট ভিজিট দিতে গেলে সৃষ্টি-চেয়ারে পেছন ঠেকাতে ঠেকাতেই ছ’মাস বিতে যাবে। নাইটহুড প্রত্যাখ্যানের চিঠি সারা বছর ধরে লিখলে একটা লোক মহাকাব্য রচবে কখন?
কমন সেন্স কাজে লাগান, ডাকসাইটে সুন্দরী বউ অবধি বছর ঘুরতে বাসি। প্রতিবাদও গোড়ার দিকটায় হেব্বি কিক দেয়, সক্কালে উঠেই লেনিন-স্তালিন-অ্যাড্রিনালিন স্রোত চাঁইই পা থেকে বেম্ম-মগজ, পরে সে জিনিস চায়ে-ডোবানো বিক্কুর ন্যায় অবধারিত মিইয়ে আসে। আর বিদ্বজ্জনরা একটু সহজে ক্লান্তও হয়ে পড়েন। সাধারণ মানুষ যখন ফুটবল পেটাচ্ছিল তখন তাঁরা সিঁড়ির পৈঠেয় হেলান দিয়ে রাশিয়ান স্টোরি হজম করে লেখকের নাম চেখভ না চেখহ্ব, উশ্চারণ ঢেকুরাচ্ছিলেন। গতর তাই বিশেষ গড়ে ওঠেনি। হর সন্ধেয় কষ্টা আঁধার যখন মানবসমাজের টাকে ঝাঁপায়, বিদ্ব-বক্ষে ২৩ কুইন্টাল এক্সট্রা মনখারাপ নিতম্ব পেতে বসে তবে তো তাঁরা অনুভূতির লাইনে এয়েচেন। এখন, এই পলকা কোমর ও আলট্রা-স্পর্শকাতর হৃদয় নিয়ে আর কত দিন কত্ত মাইল ছোটাছুটি বাগাবেন? তার ওপর গ্রাম-সাইডে নিজের টিপিন আর মিনারেল ওয়াটার বয়ে নিয়ে যেতে হয়। রক্ত-আমাশা হলে তো নিপীড়িতরা পেটে হাত বুলিয়ে দেবে না।
গাঁট প্রচুর। বিদ্বজ্জন দুই প্রকার। সিপিএমের বিদ্বজ্জন, তৃণমূলের বিদ্বজ্জন। সিপিএম-বিদ্বজ্জন মরতে দৌড়োদৌড়ি করবেন কেন? সে পার্টি কোন দিগন্তে ক্ষমতায় আসবে ঠিক নেই, পাঁচ না দশ না পনেরো বছর পর, ঝাপসা টার্গেটের পানে চেয়ে এখন থেকে ইনভেস্ট করে যাওয়ার মানে হয়? তা ছাড়া, তদ্দিনে বুড্ঢা লিডারগণ বিপ্লবোচিত ধামে গমন করবেন, যদি কেউ টিকেও থাকেন, হুইলচেয়ারে এলিয়ে বিড়বিড়: ‘এক বার মার্ক্স বলে ডাক’। যে ফক্কড়রা ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’ নারা-র তালে ফ্ল্যাগ ওড়াবে, তারা কোন উঠতি স্টার-ভাবুককে পুঁছবে কে জানে। তা হলে এখন থেকে একটা লোক কাকে তেল দেবে? কার পেছনে কাছা খুলে জিভ ঝুলিয়ে ঘুরবে? ঠিকই নেই। শুধু মিডিয়ায় নিজের নামটা ভাসিয়ে রাখার জন্যে চিটচিটে অন্ধকারে অগা তক্তপোশে মেয়েহারা মায়ের চুলে হাত বোলালাম আর গ্রাম্য মশা ৬৮ লিটার ব্লাড টেনে নিল, ও দিকে ২২ বছর পর সাহিত্য-কমিটির মাথায় বসে গেল অন্য লেখক, সে ট্র্যাজেডির পানে সেধে কেউ জগিং করে?
ছবি: সুমন চৌধুরী
আর তৃণমূলের বিদ্বজ্জন? ওরে ভাই, শজারুর ওপর শয়ন। গোড়ায়, যখন স্লোগান দিয়ে দল বেঁধে নন্দীগ্রাম গিয়ে সব্বাই মিলে মাথা চুলকে কিছু খুশকি ও অনেকটা সুচেতনা বের করে তাঁরা প্রতিজ্ঞা পুকার করেছেন, তখন সত্যি সত্যিই শিশুর ড্রয়িং খাতায় ভোরের সুয্যি-আঙ্কল টাইপ আশা, ভরসা, আগামী-নির্মাণ ঘাই মারছিল। তখন নির্দিষ্ট ধর্ষণের প্রতিবাদটা হয়ে উঠত: যে শাসন-ধরন এই ধর্ষণ-পরিবেশ তৈরি করেছে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বারাসতে দিদির শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে ভাইয়ের খুন হওয়ার ঘটনার বিরুদ্ধে চিত্‌কার শুধু ওই ভিলেনদের প্রতি আক্রোশ-শাপ ছিল না, তা ছিল সিপিএমের বিরুদ্ধে ঝকঝকে ক্রোধ-বল্লম। ধারাবাহিক অন্যায় ও ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে খোব্রানো আধলা। সেখানে একটা বৃহত্তর ম্যাপে নিজেকে গেঁথে দেওয়া ছিল। আমি আমার রাজ্যটাকে ও সমাজটাকে বদলে ফেলতে ঝাঁপ দিচ্ছি: আন্তরিক শক্তমুঠো ছিল। এখন, শাসক দল হচ্ছে সেই তৃণমূল। এ বার নিশ্চয়ই সমান সর্বভাঙু খর-চিল্লানি তোমার সত্তা হতে উত্থিত হবে না, কারণ তখন মনে হয়েছিল সিপিএম গেলেই পুলিশ হয়ে উঠবে সত্‌প্রসেনজিত্‌ আর রোববার রোববার পাঁঠা নিজে থেকে বেল টিপে বলবে ‘এই যে এলুম’, এখন দেখা যাচ্ছে ফ্যান্টাসিটা স্বল্প ওভার হয়ে গেছিল। তাই প্রতিবাদের মাঠে আর সেই বিরাটের সঙ্গে দেখাসাক্ষাত্‌ নাহি।
শুধু তাত্ত্বিক চুলকুনি নয়, পেল্লায় প্র্যাক্টি-ঝঞ্ঝাট হ্যাজ। বেশি ত্যান্ডাইম্যান্ডাই করতে গেলে, লাখ-দুলাখের চেক পাবে অন্য লোক, সে হতভাগা সনেটের মাত্রাই হয়তো হিসেব করতে পারে না, কিন্তু আনুগত্যে একেবারে চোদ্দো-বহরে ঠায় দাঁড়িয়ে, টুকুন পিছলোয়নি। তোমার বঙ্গভূষণ বঙ্গবিভূষণ, আর ক’দিন এই জমানা থাকলে বঙ্গবিভূতিভূষণ, সব সটাসট হাতের বাইরে। তাইলে বিদ্বজ্জন হয়ে কী ঘণ্টা লাভ হল? যদি প্রাইজই না পাব, টপ-সুপারিশে ফরেন না যাব, খ্যাতির গুড়েই না চপচপাব, মগজ চাব্কে ইনিয়েবিনিয়ে মুক্তো বিয়োলাম কেন? চুকচুক করে লাভ নেই, বিদ্বজ্জনের মহিমা কোনও দিনই আনপড় সমাজ বোঝেনি, রাজশক্তিই চিরকাল শাল-দোশালা জুগিয়েছে। কালিদাস টু তানসেন, লটকে লট সভায় বসে ঘটরঘটর সম্মতি-ঘাড় নেড়েছেন, কোথায় কার গর্দান অন্যায়-কচাত্‌, তা নিয়ে গাড়লের মতো বিতণ্ডা বাধাননি। আঁতেলকে এস্ট্যাবলিশমেন্ট পুষবে, এ-ই তাঁর নিয়তি ও সার্থকতা। সেটাকে বিড়ম্বিত করে অ্যাক্টিভিস্ট হওয়া যায়, টিআরপি-বান শিল্পী হওয়ায় টোটাল ঝাড়।
এ বার তক্ক: বহু বিদ্বজ্জন তো প্রতিষ্ঠানের দাসত্ব করেন না, লিট্ল ম্যাগে লেখা ছাপান। হক কথা। তাঁরা মফস্সলে কবি-সম্মেলন করেন, গাঁয়ে গোদার ছড়ান, রাত আটটায় শোপেনআওয়ারকে নিত্‌শের সামনে ফেলে দিলে কী হত ভেবে গোঁফের ফাঁকে ফিকফিক মারেন। এ রেলা প্রণম্য। মুশকিল, মহত্‌ ব্যক্তিগুলির নো গ্ল্যামার। তাঁরা নির্যাতিতের উঠোনে দাঁড়াতে গেলে, তারাই সপাট ঘাড়ধাক্কা দেবে: ‘তুমি কেডা?’ টিভিতে দেখিনি, কাগজে ফোটো থাকে না, তবে কোথাকার কে, অচেনা লোক কান্না দেখাতে এয়েচ? এই পিয়োর-বিদ্বজ্জনরা যে হেতু তাঁদের ক্ষোভকে কোনও ক্ষমতা-স্পটে যথেষ্ট তীব্রতায় পৌঁছেই দিতে পারবেন না, প্রতিবাদী হিসেবে তাঁদের বিশেষ তাত্‌পর্য নেই। লিট্ল-ম্যাগে রাগী প্রবন্ধ লেখা আর মামাবাড়ি গিয়ে টেরিফিক চেঁচিয়ে পানের বাটা ভেঙে দেওয়া একই কথা।
আরও বখেড়া: বিদ্বজ্জন হলে সংগ্রাম-পদ্ধতিতে নতুনত্ব দিতে হবে। মোমবাতি-হাঁটুনি অ্যায়সা পান্সে হয়ে গেছে, লোকে দীপাবলিতেও বাতি দিচ্ছে না, প্রতিবেশী জিগাবে, ‘কীসের প্রোটেস্ট?’ কলেজ স্কোয়ার থেকে এসপ্ল্যানেড মিছিল গজানো সম্ভব নয়, কারণ এখন আর এসএমএস-এ কোটি লোক জোগাড় হবে না, আদ্ধেক তিতিবিরক্ত বাকি আদ্ধেক কমিটিতে, আর যাঁরা তখন এ সবের মূল পাণ্ডা ছিলেন সবাই পুরাণের মধ্যে প্রাসঙ্গিক নাট্যবস্তু খুঁজতে বেজায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, আজকের জমানার কথা অধুনা-ভাষায় বলার বদলে শেক্সপিয়র থেকে খুঁটে নেওয়ায় ঝোঁক বেশি। এত প্রাচীন বই ঘাঁটলে হাঁচিও বাড়ে, তাক থেকে নামাবার শ্রমও খুব। তবে উপায়? সাচ্চা নির্বেদ আয়ত্ত করা। পৃথিবীতে ধর্ষণও চলবে, গণধোলাইও। লোকের পা কাটা গেলে সবাই ঘিরে ধরে কাটা-পা দেখবে, কেউই হাসপাতালে নিয়ে যাবে না। আমার কাজ এ সব থেকে কাব্যের রসদ সংগ্রহ ও সু-কোটেশন নির্মাণ। বা, সত্যিই এমন শিল্প তৈরি করা, যার ঝাঁঝে লোকে এই সমাজের বিরুদ্ধে কড়কড়াত্‌ রেগে উঠবে। সেই রাগ প্রায় ন’মিনিট থাকবে। তার পর সামনে দিয়ে ঝালমুড়ির লোক গেলে আলাদা কথা। তখন আমি টোকা মেরে চোখ টিপে বিদ্ব-টিপ্পনী: ‘জায়গার নামের গোড়ায় কাম রেখো না, গুচ্ছ ফ্যাচাং!’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.