প্রসবের পরে প্রসূতির রক্তক্ষরণ থামছিলই না। মুর্শিদাবাদের গ্রামীণ হাসপাতালটির ডাক্তারদের বুঝতে দেরি হয়নি যে, অবিলম্বে রক্ত দেওয়া না-গেলে বিপদ অনিবার্য। কিন্তু রক্ত আনা হবে কোথা থেকে?
কোটি টাকার প্রশ্ন!
কারণ, সবচেয়ে কাছের ব্লাড ব্যাঙ্ক তিরিশ কিলোমিটার দূরে। সেখানে রোগিণীর রক্তের নমুনা সমেত কাউকে পাঠানো, তার ম্যাচিং-ক্রস ম্যাচিং ইত্যাদি সেরে রক্ত নিয়ে ফিরে আসা এ সব কিছু হতে হতে কম করে সাত থেকে আট ঘণ্টা। অতক্ষণ সময় দেওয়া যাবে কি?
তবু ছুটেছিলেন স্বামী। রক্তের ব্যাগ হাতে যখন ফিরলেন, ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ঘণ্টা চারেক আগে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গিয়েছেন তাঁর স্ত্রী নাজমুল বিবি। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ শুরুর পরে সাকুল্যে দু’ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়। এটাই হল ‘গোল্ডেন আওয়ার।’ রক্তক্ষরণ থামানো না-গেলে এই সময়ের মধ্যে প্রসূতিকে রক্ত দেওয়াটা জরুরি। নচেৎ পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা।
অমূল্য সময় বৃথা বয়ে গিয়েছে বলেই বেলডাঙার নাজমুল বিবির মতো পরিণতি পাথরপ্রতিমার দুখি মাইতির। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক গ্রামীণ হাসপাতালে প্রসবের পরে টানা ক’ঘণ্টা রক্তক্ষরণে যখন ওঁর শরীর ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ছে, তখন অসহায় ভাবে দেখে যাওয়া ছাড়া কিচ্ছুটি করার ছিল না ডাক্তার-নার্সের। শুধুমাত্র সময়মতো রক্ত জোগাড় না-হওয়ায় ওঁরা হাত গুটিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন।
নাজমুল-দুখিদের মতো অজস্র উদাহরণ এই মুহূর্তে স্বাস্থ্য ভবনের ফাইলবন্দি। অথচ ক্ষমতায় আসার পরে প্রসূতি-সদ্যোজাতের মৃত্যু প্রতিরোধে বিশেষ গুরুত্বদানের কথা ঘোষণা করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। জানানো হয়েছিল, এ ব্যাপারে সরকারের এক গুচ্ছ পরিকল্পনা রয়েছে। শিশু-মৃত্যুর হার ঠেকাতে ইতিমধ্যে জেলায়-জেলায় সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ) তৈরিও হয়েছে। কিন্তু মায়ের মৃত্যু ঠেকানো যাবে কী ভাবে?
প্রশ্নটা প্রকট হয়ে উঠেছে, কারণ জননী সুরক্ষা যোজনায় প্রসব সংক্রান্ত খরচ মেটানোর ব্যবস্থা কিংবা গর্ভবতীকে বাড়ি থেকে হাসপাতালে পৌঁছাতে ‘নিশ্চয় যান’ (অ্যাম্বুল্যান্স)-এর সংস্থানও অবস্থা বিশেষ বদলাতে পারেনি। গলদটা তা হলে কোথায়?
শহর ও জেলাস্তরে প্রসূতি-মৃত্যুর বিভিন্ন ঘটনা খতিয়ে দেখে স্বাস্থ্য-কর্তারা এখন নিশ্চিত যে, রক্তের অভাবই এর অন্যতম বড় কারণ। যা মোকাবিলায় এ বার রাজ্য জুড়ে রক্ত সংরক্ষণের ২৩টি কেন্দ্র (ব্লাড স্টোরেজ ইউনিট) খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। এ প্রসঙ্গে মা-শিশুর মৃত্যুহার কমানোর লক্ষ্যে গঠিত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রত্যয়ী ঘোষণা, “ধাপে ধাপে আমরা অনেক কিছুই করব। ব্লাড স্টোরেজ ইউনিটের মাধ্যমে তার সূচনা হল।” স্বাস্থ্য দফতরের মাল্টি ডিসিপ্লিনারি এক্সপার্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান, চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র বলেন, “বিভিন্ন জেলায় পরিদর্শনে আমরা দেখেছি, বহু জায়গায় ব্লাড স্টোরেজ ইউনিট না-থাকায় রোগীদের বিস্তর ভোগান্তি হচ্ছে। এ রকম সব এলাকার নাম নথিভুক্ত করে সেখানে নয়া ইউনিট খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” পুরো উদ্যোগে সমন্বয়সাধনের দায়িত্বে রয়েছেন স্বাস্থ্যভবনের কর্তারা।
ঘটনা হল, পশ্চিমবঙ্গে আগে থেকেই এমন ৬০টি ইউনিট রয়েছে। তার বেশ ক’টার লাইসেন্স বাতিল হয়েছে। কয়েকটায় যন্ত্র থাকলেও টেকনিশিয়ান নেই। কোথাও আবার যন্ত্র, যন্ত্রী, দুই-ই মজুত। কিন্তু রক্ত সংরক্ষণের পাট উঠে গিয়েছে স্রেফ সদিচ্ছার অভাবে। এ হেন পরিস্থিতি ও কর্মসংস্কৃতির আবহে নতুন ইউনিট খুলে সংখ্যার দৌড়ে এগিয়ে থাকা ছাড়া অন্য সুফল মিলবে কি না, সে সম্পর্কে স্বাস্থ্য-মহলেই সংশয় দেখা দিয়েছে। কর্তারা কী বলেন?
স্বাস্থ্য দফতরের সহ-অধিকর্তা (প্রসূতি-স্বাস্থ্য) শিখা অধিকারীর জবাব, “কেন লাইসেন্স বাতিল হল, দেখা হচ্ছে। এর পুনরাবৃত্তি রোখা হবে। ড্রাগ কন্ট্রোলের সঙ্গেও কথা বলেছি। যন্ত্র খারাপের অজুহাতে যাতে মাসের পর মাস কেন্দ্র অচল না-থাকে, তাই টেকনিশিয়ানদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।” তাঁরা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোতে চাইছেন বলে মন্তব্য করেছেন শিখাদেবী।
এবং এ ক্ষেত্রে তাঁদের ‘মডেল’ পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার ব্লাড স্টোরেজ ইউনিট। কী রকম?
স্বাস্থ্য দফতরের খবর: প্রত্যন্ত এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন পরিষেবা দিয়ে চন্দ্রকোণা ইউনিট নজর কেড়েছে। যার ধাঁচে অন্যগুলোকে ঢেলে সাজার চেষ্টা চলছে। “বড় বড় ব্লাড ব্যাঙ্কের সঙ্গে স্টোরেজ ইউনিটগুলোকে জুড়ে দেওয়া হবে। নেগেটিভ, পজিটিভ মিলিয়ে প্রতি কেন্দ্রে দশ ইউনিটের মতো রক্ত থাকবে, থাকবেন এক জন ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান।” জানান শিখাদেবী। ইউনিটে সরঞ্জাম জোগাবে মেডিক্যাল সার্ভিস কর্পোরেশন। কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হবে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা-নদিয়া-পশ্চিম মেদিনীপুর-দক্ষিণ দিনাজপুরে সফল প্রশিক্ষণ হয়েছে বলে স্বাস্থ্য-সূত্রের দাবি।
“সোনার সময় যাতে নিষ্ফলা না-যায়, সেটা নিশ্চিত করাই
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।” বলছেন এক স্বাস্থ্য-কর্তা।
|
মেডিক্যাল কিট নিয়ে দরবার
নিজস্ব সংবাদদাতা • মেদিনীপুর |
মেডিক্যাল কিট চেয়ে একের পর এক আবেদন আসতে শুরু করেছে জেলা স্বাস্থ্য দফতরে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য ব্লক থেকেই এই কিট চেয়ে পাঠানো হচ্ছে। যেখানে প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধপত্র থাকবে। পশ্চিম মেদিনীপুরে সবমিলিয়ে ৪ হাজার ৭৪৭টি বুথ রয়েছে। এক- একটি বুথে পাঁচজন করে ভোটকর্মী থাকার কথা। একজন প্রিসাইডিং অফিসার। একজন ফাস্ট পোলিং অফিসার। একজন সেকেন্ড পোলিং অফিসার। একজন থার্ড পোলিং অফিসার এবং একজন ফোর্থ পোলিং অফিসার। এক- একটি বুথে পাঁচজন করে হলে ২৩ হাজার ৭৩৫ জন ভোটকর্মী কাজ করবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে। নির্বাচনের সময় যখন- তখন কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতে পারে। কেউ অসুস্থ হতে পারেন। ফলে, প্রতি বুথেই মেডিক্যাল কিট রাখা প্রয়োজন। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিকের বক্তব্য, “ব্লক থেকে কিট চেয়ে আবেদন আসছে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেই এ নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।” |