শিশুমৃত্যু কমাতে বরাদ্দ অঢেল, তবু রয়েছে উদ্বেগ
ম্প্রতি প্রকাশিত হল শিশুমৃত্যু নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা। তাতে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র অপুষ্টির কারণে বিশ্বে প্রতি বছর মৃত্যু হয় ২৬ কোটি সদ্যোজাত শিশুর। ভারতে প্রতি হাজারে ৫০টি নবজাতক মারা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য ওই হার একটু কম, প্রতি হাজারে ২৬। কিন্তু এ রাজ্যের সমস্যা হল, নবজাতকের মৃত্যু হার কমছে খুব ধীরে, খুব সামান্য। জেলা, মহকুমা হাসপাতালে উন্নত প্রযুক্তি মজুত করা হয়েছে, কিন্তু তার জন্য কতটা কমছে মৃত্যুহার, তা এখনও স্পষ্ট হয়।
শুধু ভারত নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশেই শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি, বলছে রিপোর্ট। এর মূল কারণ, মায়েদের অপুষ্টি ও অকাল-মাতৃত্ব। ইউনিসেফের একটি রিপোর্ট বলছে, এ রাজ্যে প্রতি পাঁচ জন মেয়ের একজনেরই ১৫ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়। তাদের বেশির ভাগই ১৯ বছর না পেরোতেই মা হয়ে যায়। অপরিণত বা অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেয় তারা। তার উপর প্রাথমিক বা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে উন্নত ব্যবস্থা না থাকা, বাড়িতে অধিকাংশ প্রসব হওয়ার মতো কারণও অনেকাংশেই বাড়িয়ে দেয় শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি।
তবে সরকারের আশা, নবজাতকদের জন্য উন্নত প্রযুক্তির ব্যবস্থা তৈরি করলে মৃত্যুহার কমবে। শিশু চিকিত্‌সক অসীম মল্লিক জানান, পশ্চিমবঙ্গে ৩২টি জেলা হাসপাতালে ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিইউ) তৈরি করা হয়েছে।
কেবল উন্নত প্রযুক্তি নয়, মায়েদের অপুষ্টি কমালে কমবে শিশুমৃত্যুর হার। —নিজস্ব চিত্র।
ব্লক স্তরের প্রতিষ্ঠানে চালু হয়েছে ‘সিক নিউ বর্ন স্টেবিলাইজেশন ইউনিট’ (এসএনএসইউ)। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতেও ‘নিউ বর্ন কেয়ার কর্নার’ চালু হবে। এ ভাবে স্তরে স্তরে যোগাযোগ রেখে একটি সামগ্রিক পরিষেবা গড়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবে নবজাতক কতটা সুরক্ষিত?
ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, হাসপাতালে প্রসবের হার তিন বছরে অনেকটাই বেড়েছে। ২০১২ সালে যেখানে হাসপাতালে গড়ে মাসে প্রসব হোত ৪৫০টি, চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০-র কাছাকাছি। হাসপাতালের চিকিত্‌সকদের দাবি, আগে মাসে গড়ে ৩০০ শিশু জন্মালে, তাদের মধ্যে ৫ জনই মারা যেত। কিন্তু এসএনসিইউ চালু হওয়ার পরে গত দু’মাসে ৮১ জন শিশুর মধ্যে ২ জনকে কলকাতায় বা মেদিনীপুরে রেফার করা হলেও বাকিদের এখানেই বাঁচানো গিয়েছে। আগে এটা হত না।
চিকিত্‌সকদের একাংশের বক্তব্য, জেলা হাসপাতালগুলিতে শিশুমৃত্যুর হার কমলেও, গ্রামের দিকে অবস্থাটা খুব একটা বদলাচ্ছে না। এখনও গ্রামে অনেক মহিলা বাড়িতে প্রসব পছন্দ করেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে অস্ত্রোপচার করে প্রসবের কোনও ব্যবস্থাই নেই, মহিলা চিকিত্‌সকও নেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে। অস্ত্রোপচার করাতে চান না অনেকেই। তাই নবজাতকের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
বেলপাহাড়ি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বেলপাহাড়ি ব্লকের ১৭টি গ্রামে মহিলা ও শিশুদের নিয়ে কাজ করেছিল একটি স্বেচ্ছাসেবী এক সংস্থা। তার সদস্যা স্বাতী দত্ত জানান, “শুধু হাসপাতাল বা উন্নত প্রযুক্তি থাকলেই হবে না, ঘরে ঘরে যেতে হবে। গ্রামের মায়েরা হাসপাতালে যেতে ভয় পান। ব্লক হাসপাতালগুলিতে অ্যাম্বুল্যান্স থাকলেও তা সব সময়ে ব্যবহার করা যায় না। ব্লক হাসপাতাল থেকে অনেক গ্রামেরই দূরত্ব প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার। প্রয়োজনে অত দূর থেকে যাতায়াত করা মায়েদের পক্ষে অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে।” বেলপাহাড়ি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রেও জানানো হয়েছে, আগে মাসে ১৬০ থেকে ১৭০টি শিশু জন্মাত, তাদের মধ্যে ২০ থেকে ২২টিই মারা যেত। ইতিমধ্যে শিশুমৃত্যুর হার সাত শতাংশ কমেছে।
হাসপাতালের দূরত্ব বেশি হলেও নবজাতকদের ঝুঁকি বাড়ে। সুন্দরবনের প্রান্তিক দ্বীপগুলি থেকে নিকটতম ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দূরত্ব ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার। যোগাযোগের অব্যবস্থার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতেই সময় লেগে যায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। ২০১২ সালে বাসন্তীতে প্রাথমিক ও ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব হয়েছে মোটে ৩৪৫টি। আর গোসাবায় প্রাথমিক ও ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব হয়েছে ৪৫৩টি। এই দুই ব্লকে এখনও ৩৫ শতাংশ শিশু বাড়িতে জন্মায় বলে জানালেন একটি বেসরকারি সংস্থা কর্ণধার মহম্মদ ওয়াহাব। অভিজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মীর তত্ত্বাবধান ছাড়াই শিশুরা জন্মায়। ব্লক ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হিসেবে গোসাবা ও বাসন্তী ব্লকে ২০১২ সালে ১১৬টি শিশু মারা গিয়েছে। ওয়াহাব জানান, জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন প্রকল্পে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ‘কমিউনিটি ডেলিভারি সেন্টার’ তৈরি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেখানেও প্রসবের জন্য কোনও আধুনিক ব্যবস্থা নেই। তবে পরিকাঠামোর সমস্যার চাইতেও মৌলিক সমস্যা সামাজিক বৈষম্যের। ডা. অসীম মল্লিক বলেন, “মায়েদের অধিকাংশই অপুষ্টির শিকার। ওজন ও উচ্চতা দুইই কম। তাঁরা সুস্থ শিশুর জন্ম দেবেন কীভাবে?” সদ্যোজাত ও মায়েদের মৃত্যু কমাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তৈরি করেছে একটি টাস্ক ফোর্স। তার চেয়ারম্যান চিকিত্‌সক ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার তুলনামূলক কম। তবে কম বয়সী মায়েদের অধিকাংশেরই অপরিণত সন্তান জন্মায়। অপেক্ষাকৃত সুস্থ শিশুও জন্মালেও তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশির ভাগ সময়েই তৈরি হয় না। এই ধরনের মৃত্যু নির্মূল করতে সময় লাগবে।”

তথ্য সহায়তায় কিংশুক গুপ্ত ও সামশুল হুদা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.