হিন্দিভাষী এক আটপৌরে বধূ তাঁর রোজনামচা বলে যাচ্ছেন। আর তাঁকে ঘিরে শ’খানেক মহিলা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা শুনছেন। শ্রোতাদের অনেকেই স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যা। অনেকে আবার তা-ও নয়। তাঁদের সঙ্গেই মেঝেতে বসে ওই বধূর লড়াইয়ের ‘কহানি’ শুনছিলেন পুরুলিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) সবুজবরণ সরকার।
বলরামপুরের গড়গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাসঘরের ভিতরে সবাই তখন উত্তরপ্রদেশের অমেঠি জেলার শাহগড়ের বধূ পুনম পাঠকের কথায় মগ্ন। পুনম বলে যাচ্ছিলেন, “আমার অবস্থাও খুব খারাপ ছিল। বিয়ের পরেই শাশুড়ি আমাদের আলাদা করে দেন। ছোট্ট জমিতে স্বামী চাষ করতেন। তাতে সংসার চলে না। রোজগারের জন্য দূর শহরে যাওয়ারও উপায় ছিল না।” এই সময়েই তাঁর পাশে দাঁড়ান গ্রামের এক স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যা। একটু করে পুনমদের জীবন বদলায়। শিশু কোলে বসে থাকা এক মহিলার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন পুনম, “শুনবেন পরের কথা?” জবাব আসে ভিড় থেকে “শুনব দিদি। বলুন।”
সুদূর উত্তরপ্রদেশ থেকে পুনমদের কেন এক সময়ে মাওবাদীদের হিংসা, দিনের পর দিন বন্ধে অর্থনৈতিক ভাবে ধুঁকতে থাকা বলরামপুরে নিয়ে আসা হল? উত্তরপ্রদেশ থেকে পুরুলিয়া জেলায় আসা ‘নাবার্ড’-এর ম্যানেজার অমিতা ত্রিপাঠী এর মূলে। তাঁর কাছে পুনমদের লড়াইয়ের খবর পেয়ে রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠী দফতরের মন্ত্রী তথা বলরামপুরের বিধায়ক শান্তিরাম মাহাতো নিজেও অমেঠি গিয়েছিলেন। ফিরে এসে রাজ্যের মধ্যে বলরামপুর ও পুরুলিয়া ১ ব্লকে শুরু করেছেন ‘মুক্তধারা’ পাইলট প্রোজেক্ট। পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি পুরুলিয়ায় এসে প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। সেই প্রকল্পের অংশ হিসেবেই সম্প্রতি ১০ দিন ধরে বলরামপুরের বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের কাহিনি বলে গেলেন পুনমেরা। |
পুনমদেবী জানান, নিজের এলাকার স্বনির্ভর দলের কাছ থেকে টাকা ধার করে এবং সঞ্চয় থেকে প্রথমে তিনি একটা গরু কেনেন। গরু দিনে ২ লিটার দুধ দিত। দেড় লিটার বিক্রি করে বাকিটা দুই ছেলেমেয়েকে দিতেন। প্রতি সপ্তাহে অল্প অল্প করে টাকা জমাতে শুরু করেন। মাসখানেক পরে গোষ্ঠীর ঋণ শোধ করেও তাঁর হাতে কিছু টাকা ছিল। মাস ছ’য়েক টাকা জমানোর পরে গোষ্ঠীর মাধ্যমে এ বার ব্যাঙ্ক থেকে মোটা টাকার ঋণ পান তিনি। সেই টাকায় আরও কয়েকটি গরু-মোষ কিনে পুরোদমে দুধের ব্যবসা শুরু করেন। কাছাকাছি এলাকায় একটি দুগ্ধ সমবায় রয়েছে। সেখানেই দুধ বিক্রি শুরু করেন। এখন তাঁর গোয়াল থেকে দিনে ১৮ লিটারের বেশি দুধ দুগ্ধ সমবায় সমিতিতে যায়। আত্মদীপ্ত পুনমের ইচ্ছে, “ছেলেকে পলিটেকনিক কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াব। মেয়েকে ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করিয়েছি।” পাশে বসে থাকা সঙ্গী পুষ্প সিংহ, কমলেশ মৌর্যদের দেখিয়ে পুনম বলেন, “আমার সঙ্গে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের সকলেরই অবস্থা ফিরেছে। আজ আমরা প্রত্যেকেই স্বনির্ভর।”
ভিনদেশী গাঁয়ের বধূর কথা শুনে বাস্তবিক হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন কাশিডি গ্রামের পূজা সিংহ বাবু, বনবাইদ গ্রামের প্রতিমা কিস্কু বা গড়গা গ্রামের সনকা সিংহ বাবুরা। তাঁদের ঘোর ভাঙালেন পুনমই। প্রশ্ন করলেন, “আপনারা ঋণ নিয়ে শোধ করেন তো?” সমস্বরে জবাব, “দিই তো।” শাহগড় ব্লকের ৩২টি পঞ্চায়েতের ১২ হাজার মহিলা মিলে যে ‘আস্থা মহিলা ব্লক’ সংগঠন গড়ে তুলেছেন, পুষ্প সিংহ তার ‘ব্যাঙ্ক-সখি’ বলে পরিচিত। তিনি ব্যাঙ্কের কাজকর্ম দেখভাল করেন। বললেন, “মনে রাখবেন, ঋণ সময়মতো শোধ না করলে ব্যাঙ্ক আর টাকা দেবে না। টাকা না পেলে কাজকর্ম এগিয়ে নিয়ে যাবেন কী ভাবে?” তাঁর পরামর্শ, সপ্তাহে অন্তত একদিনের মজুরি বাঁচাতেই হবে। তবেই পুঁজি হবে। আর পুঁজি বাড়লে মিলবে ঋণ। সব শুনে বলরামপুরের বনডি গ্রামের অভয়া স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সন্ধ্যারানি মণ্ডল বললেন, “আমাদের দল বছর পাঁচেক ধরে মেষ পালন করছে। ৪৫টি মেষ রয়েছে। ২২ হাজার টাকা সঞ্চয়ও হয়েছে। তা হলেও হতাশা ছিল। এই দিদিদের কথা শুনে মনে জোর পেলাম।” বনবাইদ গ্রামের প্রতিমা কিস্কুর জিজ্ঞাসা, “কাজ তো করছি। কিন্তু বাজার কোথায়? পুনম বলেন, “আমরা ওখানে একা লড়াছি। এখানে দেখছি, আপনাদের পাশে সরকার রয়েছে, আধিকারিকেরা রয়েছেন। আপনারা তো আরও সুবিধে পাবেন।” কথা শেষ করার আগে বললেন, “জানেন, এখন আমার মোটরবাইক কেনার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু আমি বা আমার ছেলে-মেয়ে সাইকেলই ব্যবহার করি। সঞ্চয়ের অভ্যাসটাই বড়।”
উত্তরপ্রদেশের ওই মহিলারা জানান, তাঁদের এলাকার বিভিন্ন গোষ্ঠীর শিক্ষিত মেয়েরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল চালাচ্ছেন। গোষ্ঠীগুলিকে ঋণ দেওয়ার জন্য তাঁরা নিজেরাই ব্যাঙ্ক খুলেছেন। পুনমের মতে, বিভিন্ন বৈঠকে গোষ্ঠীর সবাই যাতে যোগ দেন ও তাঁরা নিজেদের মতামত যাতে ব্যক্ত করতে পারেন, এটা সুনিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, “শুধু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকলেই হবে না। কোন গরিব সদস্যের মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে-- এ সবও দেখতে হয়। কিন্তু সব কিছুর মূলে আছে সঞ্চয়।” আর্থিক স্বনির্ভরতার সঙ্গে সামাজিক উন্নতির জন্য শাহগড়ে ব্লকের গোষ্ঠীর সদস্যেরা পাঁচ ধরনের কমিটি গড়েছেন। ‘অতি গরিব পহেচান কমিটি’ দুঃস্থ মহিলাদের খুঁজে বার করে গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত করে। ‘ব্যাঙ্ক লিঙ্কেজ কমিটি’ গোষ্ঠীগুলির ব্যাঙ্কের কাজকর্ম দেখাশোনা করে। ‘সামাজিক জাগরুকতা কমিটি’র কাজ সমাজ সচেতনতার প্রচার। আর স্বাস্থ্য কমিটি ও শিক্ষা কমিটি ওই দু’টি বিষয়ের কাজ দেখভাল করে। অমিতাদেবীর কথায়, “উত্তরপ্রদেশের প্রায় ২৫০টি ব্লকের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা নিজেরাই জীবন বদলে ফেলেছেন। শাহগড় ব্লকের মহিলা সংগঠনকে ব্যাঙ্ক চালাতে ২০১১ সালে ২৫ লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এখনই ওই ব্যাঙ্কের মূলধনের পরিমাণ ৭৫ লক্ষ টাকা। ইতিমধ্যে প্রথম কিস্তির পাঁচ লক্ষ টাকা তাঁরা শোধ করে দিয়েছেন। তাই এখানকার মেয়েদের উত্সাহ দিতে ওঁদের নিয়ে এসেছি।” শান্তিরামবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রকল্পের নামকরণ করেছেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর প্রতিটি সদস্যার মাসে ৩০০০-৪০০০ টাকা আয় নিশ্চিত করাই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। সেই সঙ্গে তাঁরা একে অন্যকে সাহায্য করে যাতে উন্নয়নের আলো পৌঁছে দিতে পারেন, তা-ও দেখা হবে।” |