সামনে সিপিএমের সেই পার্টি অফিস।
পাঁচ বছর আগে পঞ্চায়েত ভোটের সময় বাঁকুড়ার কোতুলপুরের এই সিহড় লোকাল কমিটির অফিস গমগম করত। অপরিচিত মুখ দেখলে, ছুটে আসত এক ঝাঁক প্রশ্ন। এখান থেকেই স্থির হত কে ভোট দেবে, আর কে দেবে না।
ছবিটা পাল্টে গিয়েছে...।
প্রশ্ন করার জন্য এখন কেউ নেই। পার্টি অফিসটা ভাঙা। গত বিধানসভা ভোটের পরেই এখানে ভাঙচুর হয়। সারানো হয়নি আর।
জয়পুর থানার হিজলডিহা গ্রামে গত বিধানসভা ভোটের পর গুলিতে খুন হন সিপিএম কর্মী বলরাম সিং। পায়ে গুলি লেগে আহত হন তাঁর বউদি অলকা সিং। “জয়পুরে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির সব আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূল জিতে গিয়েছে। শুধু জেলা পরিষদে আপনাদের দলের প্রার্থী রয়েছে। যাবেন ভোট দিতে?” ঝাঁজিয়ে উঠলেন বলরামবাবুর স্ত্রী সরস্বতী সিং। বললেন, “আমাদের দল মানে? স্বামীর মৃত্যুর পরে দলের নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এসে এক লাখ টাকা দিয়ে যান। তারপরে মরছি কি বেঁচে আছি, কেউ খোঁজ নেয়নি। পুলিশ ক্যাম্পটা রয়েছে বলে গ্রামে ঘোরাফেরা করতে পারছি।” |
বিধানসভা ভোটের পরে পাশের কোতুলপুর থানার সিহড় অঞ্চলের সাইমনি গ্রামে খুন হন সিটু নেতা অলোক বেউরা। দুষ্কৃতীরা তাঁর বাবা রামদেব বেউরার হাত মুচড়ে ভেঙে দিয়েছিল। সেই বৃদ্ধের চোখে এখনও সেই দিনের আতঙ্ক, “এই যে আপনারা এলেন, এ জন্য ওদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এমনিতেই ভয়ে থাকি, ভয় বাড়িয়ে দিলেন আপনারা।” কোতুলপুরে পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে সিপিএমের প্রার্থী নেই। কিছু আসনে কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছে। তাই পঞ্চায়েতের ১৪১টি আসনের মধ্যে ২৫টি আসনে এবং পঞ্চায়েত সমিতির ২৪টি আসনের মধ্যে ৬টি আসনে ভোট হচ্ছে। বাকি আসনগুলিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূলের প্রার্থীরা জিতে গিয়েছেন। সিপিএম জেলা পরিষদের তিনটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে।
২০০৩-এ এই কোতুলপুরে সিপিএমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে তৃণমূল, কংগ্রেস ও বিজেপি ভোট বয়কট করে। ২০০৮-এ পঞ্চায়েত সমিতির সব আসনেই সিপিএম জেতে। পঞ্চায়েতের ১২০টি আসনের মাত্র ৫টিতে তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট জেতে, একটিতে নির্দল। বাকি ১১৪টি আসন জেতে সিপিএম। সিপিএমের কোতুলপুর জোনাল সম্পাদক গৌরহরি পাল বলছিলেন, “দু’বছর ধরে এলাকায় আমাদের ৬৫টা পার্টি অফিস তৃণমূলের লোকেরা বন্ধ করে দিয়েছে। জোনাল অফিস সবে খুলেছি। এই অবস্থায় প্রার্থী দেব কী ভাবে?” দলের প্রার্থীদের নিয়ে একই সংশয় তৃণমূলের সঙ্গে জোট গড়ে বিধানসভা ভোটে জেতা কংগ্রেস বিধায়ক সৌমিত্র খাঁয়ের গলায়। ২০০৮-এ জয়পুর পঞ্চায়েত সমিতিও সিপিএমের দখলে ছিল। গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট ৬টি, সিপিএম ৯১টি, সিপিআই ৪টি ও ফব ১টি পায়। ভরদুপুরে সিপিএমের জয়পুর জোনাল অফিসের দরজা ভিতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া।
কয়েক বার ধাক্কা দেওয়ার পর সতর্ক গলায় প্রশ্ন--কে? পরিচয় দিতে দরজা খুললেন জোনাল সম্পাদক বিশ্বনাথ দে। বললেন, “শুধু থানার ভরসাতে অফিসে আসছি।” পাত্রসায়র ও বিষ্ণপুর ব্লকেও পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির বহু আসন তৃণমূল বিনা লড়াইয়ে জিতেছে। তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান শ্যাম মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “আমাদের লোকেরা প্রার্থী হওয়ার জন্য মার খেত। এ বার সিপিএমের ক’জন জখম হয়েছেন? আসলে ওরা প্রার্থীই পাচ্ছে না।” ফেরার পথে সিহড়মোড়ে একজনের পিছু-ডাক, “শুনুন, সিপিএমের হয়ে কে ভোটে দাঁড়াবে? নেতাদের সব ওপরে ওপরে সাঁট রয়েছে। ভোটে দাঁড়ালে প্রাণ তো যাবে সেই উলুখাগড়ারই।” |