চার মাসে ছেড়ে গিয়েছেন ছ’জন শিক্ষক। মে-র শেষ থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই পদত্যাগপত্র পেশ করেছেন দু’জন। এক জন চাকরি ছেড়েছেন বেতন নিয়ে আশাভঙ্গ হওয়ায় আর অন্য জন গবেষণার যথেষ্ট সুযোগ না-পাওয়ায়। আরও কয়েক জন শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে আসছেন না। আশঙ্কা, তাঁরাও হয়তো ছেড়ে চলে যাবেন।
যে-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ব মানের করে তুলতে সরকার থেকে সংশ্লিষ্ট সকলে উদ্যোগী হয়েছেন, সেই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রার সূচনাতেই একের পর এক শিক্ষক ইস্তফা দেওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ হতাশ। তাঁদের আশঙ্কা, এর ফলে ভুগবেন তাঁরাই। শিক্ষকদের ইস্তফার প্রভাব পড়বে পঠনপাঠনে।
ওই পড়ুয়ারা চান, প্রেসিডেন্সি-কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের পথ বার করুন। যদিও কেউ কেউ শিক্ষকদের ইস্তফা দেওয়ার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করছেন এবং সেটাকে আপাতত তেমন আমল দিচ্ছেন না। আবার কারও কারও মতে, প্রেসিডেন্সির মতো নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার আগে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও নিজেদের সিদ্ধান্ত বিবেচনা করে দেখা দরকার।
বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা প্রেসিডেন্সি ছাড়ছেন কেন?
ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক প্রকাশ মাইতি গত ২৭ মে পদত্যাগপত্র পেশ করেন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা ওই শিক্ষক সেখানেই ফিরে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত কারণেই চাকরি ছাড়ছেন বলে পদত্যাগপত্রে লিখেছেন তিনি। তবে উপাচার্য মালবিকা সরকার জানান, প্রত্যাশামতো বেতন না-পাওয়ায় প্রকাশবাবু প্রেসিডেন্সি ছাড়ছেন। গত ৪ জুন কর্তৃপক্ষের কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন শারীরবিদ্যা বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সুদীপ্ত সরস্বতী। তিনিও ব্যক্তিগত কারণে ইস্তফা দেওয়ার কথাই জানিয়েছেন। তবে গবেষণার যথেষ্ট সুযোগ না-পেয়ে তাঁর এই সিদ্ধান্ত বলে শারীরবিদ্যা বিভাগ সূত্রের খবর। সমাজবিদ্যার অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর শমিত কর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সরকারি কলেজে ফিরে যেতে চান। তিনিও পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। অধ্যাপক-পদে তাঁর নিয়োগ নিয়ে টানাপোড়েন এবং অন্য কিছু দাবিদাওয়া না-মেটার ফলেই ওই শিক্ষক প্রেসিডেন্সি ছাড়তে চাইছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর। এ ছাড়া পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, প্রাণিবিদ্যার তিন শিক্ষক আগেই প্রেসিডেন্সি ছেড়েছেন। পদার্থবিদ্যার অন্য এক শিক্ষক দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে আসছেন না। আর সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ ওঠায় সম্প্রতি বাধ্য হয়ে ইস্তফা দিয়েছেন ইতিহাসের অধ্যাপক বেঞ্জামিন জাকারিয়া।
পরপর এত জন শিক্ষক চলে যাওয়ায় পড়ুয়াদের একাংশ নিজেদের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের যে-সব শিক্ষক এখনও বিভিন্ন বিভাগে পড়াচ্ছেন, তাঁরা অন্য সরকারি কলেজে বদলি হয়ে গেলে শিক্ষকের অভাব আরও প্রকট হবে। তবে তাঁদের পদগুলিতে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ করা হবে এবং পঠনপাঠনে এর প্রভাব পড়বে না বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। তাঁরা বলছেন, কিছু শিক্ষক চলে গেলেও শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব সে-ভাবে অনুভূত হচ্ছে না। কারণ, অনেকেই প্রেসিডেন্সিতে আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন বলে তাঁদের দাবি। ছাত্রছাত্রীরা অবশ্য কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাঁরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা হয় সেমেস্টার পদ্ধতিতে। শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব হলে ছ’মাসের সেমেস্টারে পাঠ্যক্রম শেষ করাই দুষ্কর হবে। অর্থনীতি বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র স্নেহাশিস দে মুন্সির প্রশ্ন, “দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষকেরাই যদি প্রেসিডেন্সি ছেড়ে চলে যান, তা হলে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা থাকবেন কি? শিক্ষকেরা চলে গেলে পড়াবেন কে?” শারীরবিদ্যার সুদীপ্তবাবু এসেছিলেন আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ থেকে। তাঁর চলে যাওয়ার ঘটনায় স্নেহাশিসের আশঙ্কা আরও জোরদার হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। শিক্ষকেরা পরের পর চলে যেতে থাকায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন ইতিহাসে স্নাতক স্তরের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুতনুকা ভট্টাচার্যও।
পদার্থবিদ্যার স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র অভিনন্দন মণ্ডল বলেন, “আশঙ্কা হচ্ছে, শিক্ষকদের প্রেসিডেন্সি ছাড়ার প্রবণতা একটা ধারাবাহিক সমস্যায় পরিণত হবে। ভুগতে হবে আমাদেরই। বিজ্ঞানের পঠনপাঠন, গবেষণার সুযোগ এখনও বিদেশে অনেক বেশি। সেখান থেকে যিনি প্রেসিডেন্সিতে আসবেন, তাঁকে তো সেই রকম সুযোগ, বেতন ইত্যাদি দিতে হবে!”
তবে ছাত্রছাত্রীদের অন্য অংশ বিষয়টি নিয়ে এখনই তেমন চিন্তার কারণ আছে বলে মনে করছেন না। যেমন, সমাজবিদ্যা স্নাতকের দ্বিতীয় বর্ষের অনুজা দত্তের বক্তব্য, কয়েক জন শিক্ষক ছেড়ে দিলে পঠনপাঠনে তেমন প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। ইস্তফার ঘটনা ব্যতিক্রম বলেই মনে করছেন তিনি। একই মত স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ুয়া প্রান্তিক বসুর। শিক্ষকদের প্রেসিডেন্সি ছাড়ার ঘটনা ধারাবাহিক সমস্যায় পরিণত হবে না বলেই তাঁর আশা। |