আদিবাসীদের জায়গায় গড়ে ওঠা ছোট চা বাগান নিয়ে অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্ট জমিটি মালিককে ফেরানোর চেষ্টা করবে বলে ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু, সে চেষ্টা কতটা কার্যকর হবে বা তা করতে গেলে উত্তরবঙ্গে কর্ম সংস্থান ও অর্থনীতি কী পরিমাণ বিপর্যস্ত হবে, সেটা নিয়ে চা মহলে চলছে নানা জল্পনা। পঞ্চায়েত ভোটের প্রাক্কালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েও নানা বিতর্ক দানা বাঁধছে। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গ সফরে ও পরে মহাকরণে সরকারের ওই নীতির কথা ঘোষণাও করেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “আদিবাসীদের জমি দখলের অভিযোগ বরদাস্ত করা হবে না। চোপড়ায় এমন অভিযোগ পেয়ে ৭০০ একর জমি ভূমি সংস্কার দফতর আদিবাসীদের হাতে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আদিবাসীদের জমিতে চা বাগান করা নিয়ে অভিযোগ পেলে তা সংশ্লিষ্ট মালিকদের ফেরানো হবে।”
কিন্তু, ছোট চা বাগান তুলে দেওয়া হলে উত্তরবঙ্গের চা শিল্প নির্ভর অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। উত্তরবঙ্গের ছোট চা-বাগানের দেড় লক্ষ শ্রমিক কর্মরত। সব মিলিয়ে ছোট চা বাগিচাগুলি প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে বলে কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান স্মল টি অ্যাসোসিয়েশন (সিস্টা)-র দাবি। ওই সংগঠন সভাপতি বিজয়গোপাল চক্রবর্তী বলেন, “বামফ্রন্ট সরকার অন্তত ছোট বাগানকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিত। এই সরকার কিছুই করে না।”
|
আদিবাসী বিকাশ পরিষদে বিক্ষুদ্ধ গোষ্ঠী তথা প্রোগ্রেসিভ টি ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সভাপতি জন বার্লা কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটের কথা মাথায় রেখেই ‘মিষ্টি ঘোষণা’ করা হয়েছে বলে কটাক্ষ করেন। তাঁর দাবি, “বাম আমল থেকে আদিবাসীর জমি ফেরতের কথা শুনছি। পঞ্চায়েত ভোটের আগে মিষ্টি ঘোষণা আরও শোনা যাবে। এটা বলতে পারি, নিজের চেষ্টায় কিছু জমি দখল করেছি। রাজ্য আমাদের নামে মামলা করেছে।”
সরকারি সূত্রে খবর, অভিযোগ না পেলে ছোট বাগান বন্ধ করার কোনও অভিপ্রায় রাজ্যের নেই। ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ, চায়ের উৎপাদন ও বাগান শ্রমিকদের উপার্জনের বাস্তব পরিস্থিতি মেনে রাজ্য শ্রম দফতর ছোট বাগানকে আইনি স্বীকৃতি দিতে উদ্যোগী হয়েছে। গত মার্চ মাসে শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বলেছিলেন, “সরকার কোনও বাগান বন্ধ করতে চায় না। আমরা চাই ছোট বাগানগুলি বৈধ ভাবে ব্যবসা করুক।”
তবে অভিযোগ উঠলে বাগান বন্ধ করলে কী সমস্যার সমাধান হবে? নাকি আরও জটিলতা দেখা দেবে? কারণ, অনেক জায়গায় যাঁর জমিতে ছোট চা বাগান হয়েছে, তিনি ও তাঁর পরিবারে অনেকে সেখানে কাজ করেন। জমি পেলেও মূলধনের অভাবে তাঁরা চা বাগান চালাতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে বিকল্প কর্মসংস্থান অবশ্যই জরুরি বলে মনে করেন আদিবাসী বিকাশ পরিষদের ডুয়ার্স তরাই আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি রাজেশ লাকড়া, তেজকুমার টোপ্পোরা। তাঁদের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগকে স্বাগত। তবে ছোট চা বাগানগুলি তুলে না-দিয়ে মালিকানার সঙ্গে জমির মালিককে যুক্ত করা যায় কি না দেখতে হবে।” |
একনজরে |
কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত হতে পারে উত্তরবঙ্গে
• ২০০১ সালে ছিল ৭৪৭৬ ছোট বাগান।
• ২০১২ সালে তা হয়েছে ২১৩৯০টি।
এর অর্থ ছোট চা-বাগানের সংখ্যা ১৮৬ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে।
• গত বছর রাজ্যে চা-পাতা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৭ কোটি ৫৮ লক্ষ ৩০ হাজার কেজি।
এর ৩৮ শতাংশ, ১০ কোটি ৪৮ লক্ষ কেজি উৎপন্ন হয় ছোট বাগানগুলিতে।
• ১৯৯১ থেকে ২০১২-র মার্চ অবধি উত্তরবঙ্গে মোট ৮৮৯৬২.৮৭ একর জমিতে ছোট চা-বাগান হয়েছে।
• এ সব বাগান ও সংশ্লিষ্ট চা-শিল্পে লগ্নির পরিমাণ ৮৪৮৬ কোটি টাকার মতো।
• ছোট বাগানের পাতা থেকে চা তৈরি করার জন্য শতাধিক কারখানা গড়ে উঠেছে।
প্রতিটিতে খরচ হয় ৫ কোটি টাকার মতো। যুক্ত ত্রিশ হাজার পরিবারের দেড় লক্ষ মানুষ |
|
বাগানগুলি বন্ধ করে আদিবাসীদের হাতে জমি ফেরাতে একদা উদ্যোগী হন বাম সরকারের ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী আবদুর রেজ্জাক মোল্লাও। তিনি বলেন, “আমার আমলে আইন করে দিয়েছিলাম, আদিবাসীদের জমি নিলে কাছাকাছি অন্যত্র তাদের সমপরিমাণ, সম উর্বরতার জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। তা সম্ভব হয়নি। জমি কোথায়? কিন্তু বাগান তুলে দেওয়া অসম্ভব। রাজ্যের অর্থনীতিতে মারাত্মক চাপ পড়বে। তাই পরিকল্পনা ত্যাগ করা হয়। এই সরকারও কিছু করতে পারবে না।”
কিন্তু এসব বাগান সরকার স্বীকৃত নয় বলে পর্ষদে নথিভুক্ত নয়। পর্ষদের টি ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ডিরেক্টর গঙ্গন বোরিয়া বলেন, “ছোট বাগান যে পরিমাণ পাতা উৎপন্ন করে, তাকে অস্বীকার করা অসম্ভব। ফলে তাদের সোসাইটি তৈরি করিয়ে চা তৈরির কারখানা গড়ছি। ওই বাগানগুলোকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার ভার রাজ্যর।”
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে না বলে মনে করেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। তাঁর কথায়, “আদিবাসীদের জমি কায়দা করে বাগিয়ে চা বাগান গড়ার অভিযোগ পাওয়ার পর উদ্বিগ্ন হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গে সঙ্গে চোপড়ায় তাঁদের জমি ফেরানোর কাজ করিয়েছেন। যে সব জায়গায় এমন অভিযোগ মিলবে, সেখানেই তা করা হবে। সহজ-সরল আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য যাঁরা এই মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করে থাকেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খোঁজেন, তাঁদের মানসিকতা নিয়ে কিছু বলার ইচ্ছে হয় না। এই জন্য আদিবাসীদের কাছে ওঁদের জবাবদিহি করতে হবে।” |