আরআইপি সিডি!
ভবিষ্যতে এই বার্তাটিই কি তবে ‘টেক্স্ট’ হয়ে আসতে চলেছে?
রেকর্ড আর ক্যাসেটের মতো সিডি-ও কি এ বার চিরশান্তির পথে? গান আর সিনেমার সিডি-ডিভিডির অতি পরিচিত রিটেল চেন ‘মিউজিক ওয়র্ল্ড’ বন্ধ হওয়ার খবরে এই জল্পনাই এখন চলেছে শ্রোতা-দর্শকমহলে। পাশাপাশি, গানের নিষ্ঠাবান সংগ্রাহকরাও যে লুপ্তপ্রায় হয়ে উঠছেন সে বার্তাটাও প্রযুক্তির এই দুনিয়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ‘নেট’-এর ফাঁদে সিডি-র মৃত্যু একটু একটু করে ঘটছে অনেক দিন ধরেই। সিডি থেকে কপি করা তো বটেই, ইউটিউব-সহ আরও অনেক স্ট্রিমিং মিউজিক সাইট থেকে গান, সিনেমা এমনকী সিরিয়ালও ডাউনলোড করার কারণে একটু একটু করে ফাঁকা হচ্ছিল শহরের অধিকাংশ বিপণি। ফলে, বাণিজ্যের কথা মাথায় রেখেই পুজো কিংবা কবিপক্ষে নতুন সিডি প্রকাশ করার চলটাও কমিয়ে দিয়েছে গানের কোম্পানিগুলি। সারেগামা-র চিফ ম্যানেজার এস এফ করিম যেমন বলছেন, “প্রায় ৭০ শতাংশ বিক্রি কমে গিয়েছে আমাদের। ফলে আমরা নতুন সিডি প্রকাশ করার আগে তার বিক্রির দিকটা খুব সতর্ক হয়ে বিচার করছি। ইতিমধ্যেই আমরা ডিজিট্যাল মিউজিক প্রকাশ করাও শুরু করেছি।” বিক্রি কমে যাওয়ার ফলে তাঁরাও ইন্টারনেটেই গান প্রকাশের দিকে ধীরে হলেও হাঁটছেন বলে জানিয়েছেন মেগাফোনের কর্তা অমলকুমার ঘোষও।
তবে সিডি-র বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে কেবল ইন্টারনেটকেই দায়ী করতে রাজি নন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। প্রবীণ এই সঙ্গীতশিল্পী বলছেন, “প্রযুক্তির উন্নতিকে কে আটকাবে? কিন্তু গানের বিক্রি কমে যাওয়ার জন্য তো শুধু প্রযুক্তি দায়ী নয়। অন্তত বাংলা গানের সংস্কৃতিটাই তো এখন লুপ্তপ্রায়। নতুন শিল্পীরা তো এখন টিভিতে গিয়েও প্রচুর গান গাইছেন। ফলে সিডি কিনে গান শোনার আগ্রহটা চলে যাচ্ছে। কিন্তু পুরনো জনপ্রিয় গানের বিক্রি কমছে কি? আর যে গানের কপিরাইট আছে তা আপলোড বা ডাউনলোড করাটাই তো বেআইনি। সেটা কে আটকাবে?” এই প্রসঙ্গে শৌনক চট্টোপাধ্যায় শোনালেন এক শ্রোতার কথা, “আমার গানের এক শ্রোতা আমার নতুন সিডির সব গানগুলোই ইউটিউবে ভিডিও করে আপলোড করে দিতেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম, এতে তো যাঁর গান ভালবাসেন তাঁরই ক্ষতি করা হচ্ছে।”
শুধু তাই নয়, অন্তত বাংলা গানের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনাময় শিল্পীর পক্ষে ক্ষতিটা আরও বেশি। সঙ্গীতশিল্পী ও একটি সিডি-কোম্পানির কর্তা ইন্দ্রনীল সেন মনে করিয়ে দিচ্ছেন সেই দিকটা, “এ ভাবে কপিরাইটের সিডি নিখরচায় ডাউনলোড করে নেওয়া গেলে কোম্পানিগুলোর বিরাট ক্ষতি। তার ফলে তারা আর ঝুঁকি নিয়ে নতুন শিল্পীর গান প্রকাশ করতে চাইবে না। বাংলা গানের ভবিষ্যতের পক্ষে বিষয়টা ভয়ঙ্কর। পাইরেসি না রুখতে পারলে এটা আটকানো যাবে না। সিডি-র মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠবে।” ইন্টারনেট বা নকল সিডি, যে মাধ্যমেই হোক পাইরেসি যে কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না, সেটা স্বীকার করছেন অনেকেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিপণি মালিক বলেন, “ইন্টারনেটের যৎসামান্য খরচে যা মিলে যায়, কে আর তা বেশি পয়সা খরচ করে সিডিতে সংগ্রহ করে রাখতে চায়? স্পিলবার্গের একটি সাম্প্রতিক সিনেমার বিদেশি ডিভিডি গোটা রাজ্যের জন্য মাত্র ৫০ কপি আমদানি করেছে একটি সংস্থা। আমার দোকানে এখনও পড়ে আছে তার বেশ কিছু কপি। পড়ে তো থাকবেই। ও ছবি তো বেআইনি ভাবে ডাউনলোড করে নেওয়া যায় ইন্টারনেট থেকে!” সিডি-র ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার, সেটা অনেক আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন বলে দাবি শিল্পী প্রতীক চৌধুরীর। তিনি বলেন, “মানুষ যে প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে গান শোনার অভ্যেসটাও বদলাবে, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম বলেই গত তিন-চার বছর ধরে আমার গান আমি নিজের ওয়েবসাইট থেকেই বিক্রি করি। বিক্রিটা অবশ্য বিদেশেই বেশি হয়। কিন্তু এ দেশেও অনলাইনে গান শোনার চলটা বাড়বে বলে আমি বিশ্বাস করি। গান যদি ভাল হয়, তবে নামকরা ব্র্যান্ডের ছাপ মেরে সিডি প্রকাশ না করলেও সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়, প্রযুক্তি সেই সুযোগটা করে দিয়েছে।”
সংসার-খরচে কাটছাঁট করে সোজা পথে গান সংগ্রহ করতেন যাঁরা, সিডি হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও হারিয়ে যাওয়া মানুষ হয়ে উঠছেন এমনটাই মনে করছেন বিশিষ্ট রেকর্ড সংগ্রাহক সুশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায়। বললেন, “পুরনো বাড়ি থেকে আমি এখনও এলপি রেকর্ড সংগ্রহ করি। তেমন বাড়িও কমে আসছে। সংগ্রহ করতে গিয়েই দেখেছি, বিদেশ থেকে কত দামী রেকর্ডও এক সময়ে আনাতেন পুরনো দিনের বিশিষ্ট শ্রোতারা। সেই ধারাটা থেমে গিয়েছে। রেকর্ডের যুগ শেষ, ক্যাসেটের যুগও। এ বার হয়তো সিডিও...”
কে জানে এর পরে সিডিও হয়তো মিলবে শুধু ওয়েলিংটন-ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের রেকর্ড পাড়াতেই! |