অলস রাজু কোনও কাজ করত না। সারাদিন বাড়িতে বসে স্বপ্ন দেখত, একদিন সে ঠিক টাকার গাছের খোঁজ পাবে আর মস্ত বড়লোক হয়ে যাবে। শেষমেশ বিধবা মায়ের বকুনি খেয়ে বাইরে বেরোল রাজু। তবে কাজ নয়, টাকার গাছ খুঁজতে।
কমিকসে মশগুল ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়ার দল তো হেসে কুটোপাটি। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, ‘‘কী বোকা রে বাবা, জানে না টাকার গাছ বলে সত্যি কিছু হয় না।” ওদের মধ্যে একজন আবার একটু গম্ভীর। সে বলল, “বাবাও তো না জেনে লগ্নি সংস্থায় টাকা রেখেছিল। কত ক্ষতি হল!”
এই ছবি স্কুলে স্কুলে ‘রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’ আয়োজিত সচেতনতা শিবিরের। সম্প্রতি পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে টাঁকশালের কাছেই গোদাপিয়াশাল হাইস্কুলে বসেছিল এমন এক আসর। অনেক ছাত্রছাত্রী প্রশ্ন করে বুঝতে চেয়েছিল, ব্যাঙ্কের সঙ্গে অর্থলগ্নি সংস্থার ফারাকটা ঠিক কোথায়। বোঝা গিয়েছিল,
সারদা-কেলেঙ্কারির প্রভাব পড়েছে কিশোর মনে। কোথায় টাকা রাখলে, কী ভাবে রাখলে ষোলোআনা নিরাপত্তা মিলবে, সেটা ওরাও জানতে চাইছে, বুঝতে চাইছে।
স্কুলে স্কুলে সচেতনতা কর্মসূচিতে তাই বিশেষ জোর দিচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। জেলায় জেলায় ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আয়োজন করা হচ্ছে ক্যুইজ, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, আলোচনাসভার। সবেরই বিষয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার খুঁটিনাটি। ব্যাঙ্ক-বিষয়ক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতাও হচ্ছে। পড়ুয়াদের দেওয়া হচ্ছে রাজু এবং মানি কুমার সিরিজের কমিকস, দেখানো হচ্ছে সিডি। লক্ষ্য একটাই স্কুলপড়ুয়াদের সেতুবন্ধ করে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষকে ব্যাঙ্কমুখী করে তোলা। |
সচেতনতায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কমিকস। (সৌজন্যে আরবিআই) |
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রিন্সিপাল চিফ জেনারেল ম্যানেজার (কমিউনিকেশন) আলপনা কিল্লাওয়ালা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ১৯টি জেলায় একটি করে স্কুলে এই কর্মসূচি হয়েছে। চারটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা আবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কলকাতা অফিসে ঘুরে গিয়েছে। কাছ থেকে দেখেছে, ব্যাঙ্কিং দুনিয়ার বিপুল কর্মকাণ্ড।
স্কুলপড়ুয়াদের এ সব বোঝানোর উদ্দেশ্য কী? আলপনার কথায়, “এই স্কুলপড়ুয়ারা অভিভাবক, পাড়া-প্রতিবেশীদের সচ্ছন্দে বোঝাতে পারবে ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে, ঋণ নিলে কত সুবিধা। ছাত্রছাত্রীদের সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এই পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।”
সারদা-কাণ্ড যে তাঁদের চোখ খুলে দিয়েছে, সম্প্রতি তা স্বীকার করেছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ডি সুব্বারাও। এই ঘটনায় আইনের ফাঁক তো সামনে এসেইছে, সঙ্গে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, প্রত্যন্ত এলাকার বহু সাধারণ মানুষ ব্যাঙ্কের পরিবর্তে ছোটখাট লগ্নি সংস্থায় টাকা রাখতে আগ্রহী। এই সব সংস্থার লোভনীয় ‘স্কিম’ যেমন এর জন্য দায়ী, তেমনই কাছাকাছি এলাকায় ব্যাঙ্ক না থাকাও এর একটা কারণ। পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলায় বহু পঞ্চায়েতে সরকারি-বেসরকারি-সমবায়, কোনও ব্যাঙ্কই নেই। যেমন, বর্ধমানে ৯৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ব্যাঙ্ক নেই। পশ্চিম মেদিনীপুরে সংখ্যাটা ৮০, মুর্শিদাবাদে ৭২, নদিয়ায় ৪৪। এই সব এলাকায় দ্রুত ব্যাঙ্কের শাখা খোলার চেষ্টা যেমন চলছে, তেমনই মানুষকে ব্যাঙ্কমুখী করতে জোর দেওয়া হচ্ছে ব্যাঙ্ক সম্পর্কিত প্রাথমিক পাঠে। এরই অন্তর্গত স্কুলে সচেতনতা শিবির, সারদা-কেলেঙ্কারির পর যা বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে।
ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞাসাতেও সারদার ছায়া। কেউ জানতে চাইছে, ব্যাঙ্কের লোক আর লগ্নি সংস্থার লোকের মধ্যে ফারাক বুঝব কী করে? কারও প্রশ্ন, কোনও লগ্নি সংস্থাই কি নিরাপদ নয়? লেখাপড়ার জন্য কী ভাবে ঋণ পাওয়া যায়,
তা-ও জানতে চাইছে অনেকে। শালবনির স্কুলে গিয়েছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের লিড ডিস্ট্রিক্ট ব্যাঙ্ক ম্যানেজার (এলডিএম) সমরেন্দ্র সন্নিগ্রাহী। তিনি বলেন, “সর্বত্র ছেলেমেয়েরা সারদা নিয়ে প্রশ্ন করছে। অন্য প্রশ্নও আছে। আমরা বোঝাচ্ছি সঞ্চয় হোক বা ঋণ, ব্যাঙ্কই নিরাপদ।” নিঃসংশয় হতে বাড়িতে আসা ব্যাঙ্কের প্রতিনিধির (বিজনেস করসপনডেন্ট) পরিচয়পত্র দেখতে বলছেন ব্যাঙ্ক-কর্তারা। কোনও প্রশ্ন থাকলে সরাসরি ফোন করা যেতে পারে এলডিএমদেরও। বর্ধমানের এলডিএম সুজিতকুমার সরকারের কথায়, “ব্যাঙ্ক নিয়ে গ্রামের মানুষের ভীতি আছে। পড়ুয়াদের বুঝিয়ে আমরা সেই ভয়টা ভাঙতে চাইছি। সঙ্গে বলছি, হঠাৎ বড়লোক হওয়া যায় না। বাবা-মাকে বলো, লগ্নি সংস্থার কথায় না ভুলে ব্যাঙ্কে টাকা রাখতে।”
কমিকসের চরিত্র রাজুও শেষ পর্যন্ত বুঝেছে, টাকার গাছ বলে কিছু হয় না। তবে রোজগারের টাকা ঠিকমতো ব্যাঙ্কে রাখলে সুদ মেলে, অঙ্কেও বাড়ে।
|