উত্তরবঙ্গে আটান্ন শতাংশ চা-বাগানে শ্রমিকদের চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থাই নেই। পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ২২ শতাংশ বাগানে। আইন অনুসারে এ সব ন্যূনতম প্রয়োজনের ব্যবস্থাগুলি করার কথা বাগান কর্তৃপক্ষেরই। কিন্তু এ রাজ্যের অন্যতম প্রধান শিল্পের শ্রমিক সংগঠন বা বাগান-মালিক, কোনও তরফেরই আইন মানার আগ্রহ নেই। রাজ্য সরকারের সমীক্ষায় এ সব তথ্য উঠে এসেছে। গত বছর অক্টোবরের শেষ দিকে পুজোর ছুটির পরে রাজ্য সরকারের শ্রম দফতরের শিলিগুড়ি শাখা সমীক্ষার কাজ শুরু করে। সম্প্রতি রিপোর্টটি আসে শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর হাতে।
এই বাগানগুলির প্রতিটিই ১৯৫১ সালের প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্টের অধীন। এই আইন অনুযায়ী বাগানে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে কর্মরত প্রায় ৫ লক্ষ শ্রমিকের চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু শ্রম দফতরের সমীক্ষকেরা সরেজমিনে দেখতে গিয়ে তাজ্জব বনে গিয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন ২৭৩টি বাগানের মধ্যে ১৬৬টিতে ‘হাসপাতাল’ নাম দিয়ে বাড়িঘরের অস্তিত্ব দেখানো হলেও তার মধ্যে মাত্র ৭৪টিতে এমবিবিএস ডাক্তার থাকেন। এই ১৬৬টি ‘হাসপাতালে’র মধ্যে ১১৬টিতেই নার্সের দেখা পাননি সমীক্ষকেরা।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তা হলে এতগুলো ‘হাসপাতালে’ কারা ডাক্তারি করেন? কারাই বা রোগীদের সেবা করেন? ডাক্তার বা নার্স যেখানে নেই, সেগুলিকে কোন যুক্তিতে ‘হাসপাতাল’ বলছেন বাগান কর্তৃপক্ষ?
তবে এই ‘আছে’র পাশাপাশি একেবারে ‘নেই’এর হিসেবও সমীক্ষায় উঠে এসেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাহাড়ের ৬৪, তরাইয়ের ২০ এবং ডুয়ার্সের ২৩টি অর্থাৎ মোট ১০৭টি বাগানে কোনও হাসপাতালই নেই।
কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা? ১৬০টিতে বা আটান্ন শতাংশ বাগানে কোনও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অস্তিত্বও খুঁজে পাননি সমীক্ষকেরা। কর্তৃপক্ষের তরফে দাবি করা হয়েছিল বাগানগুলিতে অ্যাম্বুলেন্স আছে। সমীক্ষকেরা মন্তব্য করেছেন, “সেগুলির বেশির ভাগ অচল।” চা-বাগানগুলিতে কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে চরম অবহেলা ছড়িয়ে রয়েছে। কর্তৃপক্ষ এ ভাবেই আইন লঙ্ঘন করে চলেছেন, কার্যত এমন মন্তব্যই করেছেন সরকারি সমীক্ষকেরা।
একই অবহেলার চিত্র দেখা গিয়েছে পানীয় জল সরবরাহের ক্ষেত্রেও। ২৭৩টি চা-বাগানের মধ্যে ২১২টি বাগানের আপামর শ্রমিক পরিবারকে পানীয় জল বলতে নির্ভর করতে হয় পাহাড়ি ঝর্ণা বা নদীনালার ওপর, এমনটাই বলা হয়েছে সমীক্ষায়। ফলে শ্রমিক বস্তিতে নিয়মিত অসুখবিসুখ লেগেই থাকে। এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গেলে শ্রমিক পরিবারগুলিকে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হয়। অথচ প্ল্যান্টেশন লেবার আইন অনুযায়ী বাগান কর্তৃপক্ষেরই এগুলির ব্যবস্থা রাখা কর্তব্য।
শ্রম দফতরের আধিকারিকেরা জানান, এ রাজ্যে এই ধরনের সমীক্ষা এর আগে কখনও করা হয়নি। ফলে প্রকৃত চিত্র কী, তা সরকারের কাছে স্পষ্ট ছিল না। শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বলেন, “আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর চা-বাগানের আসল চেহারাটা কী জানার জন্য এই সমীক্ষা করানোর উদ্যোগী হই। যে রিপোর্ট পেলাম তা রীতিমতো উদ্বেগজনক।
এ বার থেকে যে সব ত্রিপাক্ষিক আলোচনা হবে, এই সব অভাব-অভিযোগকে কেন্দ্র করে হবে।” এই পরিস্থিতির জন্য নিজেদের দায়িত্ব অস্বীকার করেননি ১৭টি শ্রমিক ইউনিয়নের কো-অর্ডিনেশন কমিটির আহ্বায়ক চিত্ত দে। তিনি বলেন, “এই পরিস্থিতি এক দিনে হয়নি। বহু বছর ধরেই এমন আছে। তার জন্য আমাদের মতো সংগঠনের নেতৃত্বেরও দোষ আছে, অস্বীকার করছি না।”
তবে ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে অরিজিৎ রাহা-র দাবি, “আমাদের সংগঠনের সদস্যদের বাগানে ডাক্তার আছে বলেই জানি।” একই সঙ্গে তিনি এ কথাও বলেন, “অভাব আছে, অস্বীকার করছি না।” |