বাংলার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রায় ১৫০ বছরের। কিন্তু বাংলা ভাষাটা শেখা হয়ে ওঠেনি। বাংলায় আমাদের আসা মজুরি খাটতে। সম্পর্কটাও তাই মালিক ও মজুরের। কথা বলার সুযোগটাই কোথায় যে ভাষা শেখা হবে?— মুন্নি হেমব্রম কথাগুলো বলছিলেন হিন্দিতে, সেটাও বোধহয় একটু কষ্ট করে। বছর চল্লিশের মুন্নি জাতিতে সাঁওতাল। নিবাস ঝাড়খন্ডের দুমকা জেলায়। সাঁওতালি তাঁর মাতৃভাষা, হিন্দি তাঁকে শিখতে হয়েছে কাজের প্রয়োজনে— কেননা ওটা শাসকীয় ভাষা, পশ্চিমবঙ্গে যেমন বাংলা। বাংলায় বলতে না-পারার জন্য তাঁর ক্ষমাপ্রার্থনা কিন্তু অকৃত্রিম। চল্লিশ মিনিটের বক্তৃতার পুরোটাই বলে গেলেন স্বাভাবিক কথা বলার ভঙ্গিতে। কখনও প্রায় অস্ফুট সে কণ্ঠ, কোনও বিরাগ নেই, দ্বেষ নেই, গলা উঁচু না করেও যে আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করা যায়, সেটা দেখা গেল গত ২৫ এপ্রিল, কলকাতায় রিজার্ভ ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন আয়োজিত সভায়। তাঁর অনুচ্চ কণ্ঠের বক্তৃতায় মুন্নি তুলে দিয়ে গেলেন নারীর সক্ষমতা ও অধিকারের সংজ্ঞা এবং তার অনুশীলন নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা।
নারীস্বাধীনতার বিষয়টি যে দৈনন্দিন জীবনের আর্থিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত থেকে দেখার একটা ব্যাপার, সেটাই ছিল মুন্নির বক্তব্যের মূল সুর। আগে তাঁদের যে জমি ছিল, ইংরেজরা সে জমিতে খাজনা এতটাই বাড়িয়ে দেয় যে অধিকাংশ সাঁওতাল চাষিকে জমি বন্ধক রেখে খাজনা ভরতে হয়। এ ভাবেই চাষিরা জমিতে অধিকার হারাতে থাকেন, মজুর হয়ে ওঠেন। সেই সূত্রেই ধান কাটার কাজের জন্য তাঁদের বাংলায় আসা। কেউ কেউ আবার একটু বেশি দিনের কাজের আশায় পাড়ি দেন দূর দূর প্রান্তে।
সাঁওতাল নারীদের কিন্তু কোনও কালেই জমির উপর কোনও অধিকার ছিল না। অথচ, কথিত আছে, সাঁওতাল আদি পুরুষ হাড়ামের হাতে প্রথম লাঙ্গলটি তুলে দেন আদি সাঁওতাল নারী বুড়ি। আশীর্বাদস্বরূপ পুরুষটি নারীকে ভবিষ্যতে কর্ষণজনিত সমস্ত রকম কাজ থেকে অব্যাহতি দেন, অর্থাৎ প্রকারান্তরে লাঙ্গলের তথা জমির অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করেন। কিন্তু মুন্নি তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিলেন যে, এই জমিই তাঁদের জীবন। সরকার প্রতিশ্রুত বিভিন্ন আশা যখন নিরাশায় পর্যবসিত হতে থাকে, তখন কৃষককে তার জমিই বাঁচিয়ে রাখতে পারে। তাই মেয়েদের জমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলে তারা কোনও দিনই স্বাধীন হয়ে উঠতে পারবে না। ‘অন্নপূর্ণা তুমি সুন্দরী, অন্নহীনা তুমি ভীষণা’— মুন্নিরা রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্র পড়ার সুযোগ পান না, কিন্তু তাঁর কথাগুলো তো মুন্নিদের জীবনে প্রবল ভাবে দৃশ্যমান।
পটনার একটি অসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় শুরু হয় মুন্নিদের কাজ মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু এখানেও বঞ্চনা! মুন্নিদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান তাদের ঠকাতে শুরু করে। বীতশ্রদ্ধ হয়ে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেন মুন্নিরা। অসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা কয়েক জন মিলে খুলে ফেলেন একটা সংগঠন। ভীষণ রকম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই শুরু হয় পথ চলা। যত দিন যায় কাজ বাড়তে থাকে, অভিজ্ঞতাও বাড়তে থাকে, জমির গুরুত্বও মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। খানিকটা সংঘর্ষ, মনোমালিন্য, আবার আংশিক সম্মতি ইত্যাদি নিয়েই কিছু জমিতে চাষ শুরু করেন মহিলারা। নিজেদের বাড়ির লোকেদের জমি— বছরের যে সময়টায় চাষ হয় না, পড়ে থাকে, সে সময়টাকেই তাঁরা বেছে নেন চাষের জন্য। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অসময়েও ফসল ফলান। যে জমি পরিচিত ছিল চাষের অযোগ্য বলে, তাতেও চাষ করেন তাঁরা। উৎপাদনের কিছু অংশ নিজেরা ভাগ করে নেন, কিছুটা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেন, বাকিটা অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়। মানুষ আকৃষ্ট হতে থাকেন মেয়েগুলোর এই উদ্যোগে। উপলব্ধি করেন, ক্ষতি তো নয়ই বরং লাভই বেশি। কাজ চলতে থাকে। বর্তমানে মুন্নি তাঁর অঞ্চলে ২২৮টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছেন। তিন হাজারেরও বেশি সদস্য। এঁরা সমাজের এমন একটি অবস্থানে আছেন, যেখানে দাঁড়িয়ে অন্যরাও তাঁদের পরামর্শ দিচ্ছেন। |
এই যে নতুন ধরনের চাষাবাদ, যা সাঁওতালদের বহু দিন ধরে চলে আসা অনুশীলনগুলোর সঙ্গে আধুনিক কিছু প্রযুক্তির মেলবন্ধনে তৈরি— আধুনিকতার বিষবাষ্প ছাড়াই— এটা সাধারণ চাষিদের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। আর এটাই মেয়েদের দিয়েছে আলাদা সম্মান। এই সঙ্গে আছে অন্যান্য কর্মনিয়োজন প্রকল্প। আর সবচেয়ে জরুরি হল জীবন-জীবিকার সংগ্রামের স্তরে স্তরে গড়ে ওঠা অভিজ্ঞতা, যা তাঁদের প্রেরিত করে বিদ্যালয় শিক্ষার উন্নতির দিকে। গ্রামের বিদ্যালয়গুলিতে আজ তাঁরা সকলকে মিড-ডে-মিল সম্পর্কে সচেতন করতে পেরেছেন। বিদ্যালয়ের মাতা কমিটির মিটিংগুলিতে মেয়েদের উপস্থিতি আজ লক্ষণীয়।
‘পাশের গ্রামের যে মহিলা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেও কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলত, আজ তাঁরা আমাদের ডেকে নিয়ে যান, তাঁদের মধ্যেও দল তৈরি করে দিতে বলেন।’ বলতে বলতে চিকচিক করে ওঠে মুন্নির চোখ। অধিকার কারও দয়াপরবশ দান নয়। আইন করেও তা সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অনুশীলনের মাধ্যমেই তা অর্জন করা যায়। সক্ষমতার অর্থ কি শুধুই নিজের স্বনির্ভরতা? না। আজ মুন্নিদের স্বনির্ভরতার ফল ভোগ করছেন তাঁদের গোটা গ্রাম। আজ তাঁদের গ্রামে কেউ সহজে বহুবিবাহ করার বা মদ খেয়ে এসে বউকে পেটানোর সাহস পান না। যে মুন্নি আগে মুখ তুলে কথা বলার সাহস পেতেন না, আজ তিনি দৃঢ় ভাবে সব কিছু মোকাবিলা করছেন, জোর গলায় ব্যাংক ম্যানেজার বা জেলাশাসকের সঙ্গে কথা বলছেন।
নারী ভোটাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ ক্রিস্টাবেল প্যাংকহার্স্ট ১৯১১’য় দাবি করেন, ‘আমরা এখানে মেয়েদের অধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য সমবেত হয়েছি, যে দাবি শুধু স্বাধীন হওয়ার জন্যই নয়, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার।... এ শুধু আমাদের অধিকারই নয়, কর্তব্যও বটে।’
মুন্নি হয়তো প্যাংকহার্স্ট-এর নাম শোনেননি। কিন্তু একশো বছর আগের এক শ্বেতাঙ্গিনীর কথাগুলো অক্ষরের মাধ্যমে না হলেও অভিজ্ঞাত অনুভূতিতে বহু দূরের এক কৃষ্ণকায় রমণীর কণ্ঠে এখনও অনুরণিত। নারীস্বাধীনতার চলমান সংগ্রামে এই স্ফুট-অস্ফুট কণ্ঠের অবদান অনস্বীকার্য।
|
প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত |