|
|
|
|
সাক্ষাত্কার... |
পৌরুষের ছক ভেঙে কৃষ্ণ যখন অন্য পুরুষ
স্বপ্নসন্ধানী নাট্যগোষ্ঠীর মহাভারত-ভিত্তিক একটি নাটকে কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয়ের
জন্য
কিছু কাল আগে দেড় মাস ধরে রিহার্সাল দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। সেই অভিজ্ঞতা,
আর তার থেকে
উঠে আসা মহাভারতের, এবং বিশেষ করে, কৃষ্ণচরিত্রের এক নতুন
পাঠ নিয়ে
পরিচালক
কৌশিক সেন-এর সঙ্গে কথা বললেন শিলাদিত্য সেন |
|
শিলাদিত্য: বুদ্ধদেব বসুর ‘কালসন্ধ্যা’ নাটকে তুমি তো নিজেই কৃষ্ণ করতে পারতে, হঠাৎ ঋতুপর্ণ ঘোষকে ভাবতে গেলে কেন?
কৌশিক: ভেবেওছিলাম প্রথমে নিজে করব, বা আমি না করলে দেবশঙ্কর (হালদার) কিংবা সুরজিৎকে (বন্দ্যোপাধ্যায়) দিয়ে করাব। কিন্তু পড়তে পড়তে কেন জানি না ঋতুদার কথা মনে পড়ল। এ নাটকে কৃষ্ণ তো একটা অদ্ভুত লোক, যে অসম্ভব বুদ্ধিমান, সব জানে, এমনকী নিজের পরিণতিটাও জানে। এখানে সে নির্বান্ধব, নিঃসঙ্গ, এবং একা।
ঋতুকে যতটা চিনতাম, তাতে ওর চরিত্রের সঙ্গে তোমার কৃষ্ণ-চরিত্রের আশ্চর্য মিল। শেষ বার যখন দেখা হয়েছিল, তখনও বলছিল ওই নির্বান্ধবতার কথা, অনেকেই ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশে, কিন্তু ও নিজে ভিতর থেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ এবং একা। অসম্ভব বুদ্ধিমানও, তবে পরিণতির কথা জানত কি না বলতে পারব না। তুমি কি এখানে কৃষ্ণের পরিণতির কথা বলছ গান্ধারীর অভিশাপের সূত্রে?
আমি ‘কালসন্ধ্যা’ শুরুই করেছিলাম গান্ধারীর অভিশাপ দিয়ে।
গান্ধারী তো খুবই প্রিয় চরিত্র ছিল ঋতুর, কৃষ্ণ করতে কি তাই রাজি হয়েছিল?
হতে পারে। আমি যখন এক দিন বিকেলে ফোনটা করলাম, তখন মনে হল ঋতুদা যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল। কথা বলতে বলতে বুঝতে পারছিলাম, ঋতুদা অনেকটা সময়ই মহাভারত-এর ভিতর বসবাস করে। বলেছিল যে, মহাভারত নিয়ে ছবি করলে গান্ধারীকে দিয়ে শুরু করবে। সত্যজিৎ রায় মহাভারতের দ্যূতক্রীড়ার অংশটা নিয়ে ছবি করবেন ভেবেছিলেন।
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীকেও একই কথা বলেছিল, হয়তো এ রকম কথা অন্য কোনও নিকটজনকেও বলেছিল। তবে পৌরুষ প্রদর্শন বা ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশের জন্যে পুরুষের এই যে পাশা খেলা, তার উল্টো দিকে এক নারী গান্ধারীর বিলাপ দিয়ে শুরু করা...
আমার নাটকের শুরুতে গান্ধারীর ওই বিলাপের দৃশ্যটা অসম্ভব ভাল লেগেছিল ঋতুদার। আমি গান্ধারীর শতপুত্রের মতো তার শোকটাকেও শতটুকরো করে দিয়েছিলাম। মঞ্চে তাই বহু গান্ধারী, তাদের প্রত্যেকের চোখেই বস্ত্রখণ্ড। তারা কেউ শোকে স্তব্ধ, কেউ মুমূর্ষের পরিচর্যায় রত, কেউ-বা মৃতের স্তূপ পার হয়ে চলেছে। তারা সকলেই বিলাপ করে, গোল হয়ে ঘিরে ধরে অভিসম্পাত করে কৃষ্ণকে। তাদের মধ্যে রাজ্ঞী গান্ধারী কৃষ্ণকে বলে: তুমি যেমন কুরু-পাণ্ডবের বিনাশ ঘটালে, তেমনই তোমার জ্ঞাতিগোষ্ঠীরও ধ্বংসের কারণ হবে তুমি, আজ থেকে ছত্রিশ বছর পরে পুত্রহীন জ্ঞাতিহীন... তার শেষ কথাগুলো চাপা পড়ে যায় জলোচ্ছ্বাসের শব্দে।
এ কৃষ্ণ ক্লান্ত অভিশপ্ত একটা চরিত্র।
হ্যাঁ। প্রজ্ঞাবান, কিন্তু তার কর্তব্যকর্ম সব শেষ হয়ে গিয়েছে। সে টের পাচ্ছে তার নিজের ভিতরে ক্ষয় শুরু হয়েছে, কিন্তু সে নির্বিকার। এই নিস্পৃহ নির্লিপ্ত ভাবটা ইদানীং ঋতুদার মধ্যে লক্ষ করতাম। |
|
শিল্পী: সুমন চৌধুরী |
আগেও তো তুমি মহাভারত থেকে নাটক করেছ, বুদ্ধদেব বসুরই ‘প্রথম পার্থ’, সে নাটকে কৃষ্ণ কিন্তু ‘লার্জার দ্যান লাইফ’, পুরোদস্তুর পৌরুষ নিয়ে উপস্থিত। ‘কালসন্ধ্যা’য় প্রায় তার বিপরীত চরিত্র কৃষ্ণের। মহাকাব্যের বাড়ানো উচ্চতার বদলে এক অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে হাজির এখানে কৃষ্ণ। ঋতুদাকে নির্বাচনও সে জন্য, আবার ঋতুদারও খুব পছন্দ হয়েছিল কৃষ্ণ-চরিত্রের এই বিন্যাস। এপিক নয়, ইন্টিমেট থিয়েটার ‘কালসন্ধ্যা’। পঞ্চাশ জনেরও কম দর্শক ধরে এমন একটা হল-এ নাটকটা মঞ্চস্থ করব ভেবেছিলাম, যাতে স্পর্শযোগ্য দূরত্ব থেকে দর্শক দেখতে পায় কৃষ্ণকে। কৃষ্ণ এখানে অর্জুনের সখা, প্রবল পৌরুষের বদলে পুরুষের সংজ্ঞা ছেড়েই যেন বেরোতে চাইছে সে, তার একটা সংলাপই আছে:
‘চিরকাল ধ’রে আমি
ছিলাম তোমার সঙ্গে...
পাঞ্চালীর স্বয়ংবরে, খাণ্ডবদাহনে,
কুরুক্ষেত্রে, স্বর্গে, মর্ত্যে, বনবাসে, সংহারে, বিজয়ে,
এমনকি পানে, স্নানে, ভোজনে, বিশ্রম্ভালাপে
এমনকি বাসরশয্যায়।’
ঋতুদার মুখে এ উচ্চারণ এত অনায়াস যে অন্য কেউ বললে বোধহয় কৃত্রিম শোনাত। সংলাপটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলত না ঋতুদা, ওর শরীরের নিজস্ব একটা ছন্দে চলাফেরা করতে-করতে বলত, তার সঙ্গে হাল্কা একটা নাচের মুদ্রাও আমি জুড়ে দিয়েছিলাম। প্রায় অন্ধকারে অর্জুন শুধু স্পর্শটুকু পাচ্ছিল কৃষ্ণের। বোঝাই যাচ্ছে তার সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে, তবে এ-সম্পর্কের মধ্যে কোনও প্রকট যৌনতার ইঙ্গিত আমি রাখিনি, কারণ সেটা এ-নাটকের এক্তিয়ারে পড়ে না।
ঋতু বলত: এক পুরুষের ভিতর এক নারীও বসবাস করে। যে পৌরুষ শেষ পর্যন্ত শুধু ক্ষমতা-র সমীকরণই বোঝে, সে পৌরুষের বিকল্প এক চরিত্র ‘কালসন্ধ্যা’র কৃষ্ণ। আচ্ছা, এর আগে যখন বুদ্ধদেবের ‘প্রথম পার্থ’ ছাড়াও ‘অনাম্নী অঙ্গনা’ করেছ, তাতে কর্ণ বা অঙ্গনা ছিল সূতপুত্র বা দাসী, তাদের আমরা প্রান্তিক ভাবতেই পারি। ‘কালসন্ধ্যা’তেও কি প্রান্তিক মানুষজনের কথা?
অবশ্যই। ‘কালসন্ধ্যা’ও আমাকে প্রান্তিক বা নিম্নবর্গের মানুষজনের কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছিল। ইউরিপিদেসের ‘ত্রোইআদেস’-এ ট্রয়ের যুদ্ধে ধ্বংসের কথা পড়ছিলাম, পড়তে পড়তে হঠাৎ ধরে ফেলি বুদ্ধদেব বসুর নাটকটা, সেটা পড়তে শুরু করি। সেখানেও যুদ্ধশেষের পরের অবস্থা। মহাভারতের যুদ্ধ তো আসলে উচ্চবর্গের যুদ্ধ, একটা পারিবারিক যুদ্ধ, আর তাতে জড়িয়ে পড়ছে দেশের সাধারণ মানুষ। অথচ এতে তাদের কোনও লাভ নেই, বরং ভয়ংকর ক্ষতি। যুদ্ধ বা ধ্বংসের পর সবচেয়ে খারাপ হয় নারী-শিশু-বৃদ্ধদের অবস্থা। এই যে ধ্বংস বা যুদ্ধ-পরবর্তী একটা দেশ, তাতে অনেক সময়ই প্রতিশোধ নিতে উত্থান ঘটে প্রান্তিক বা নিম্নবর্গের মানুষজনের, উগ্রপন্থার জন্ম হয়, নিহত হতে হয় কোনও না কোনও দেশনায়ককে।
‘কালসন্ধ্যা’য় সেই দেশনায়কই কৃষ্ণ, আর তাকে নিহত হতে হয় ব্যাধের হাতে।
আমি এক জন ব্যাধ নয়, ব্যাধের দল এনেছি এ নাটকে। নাটকের একেবারে শেষে আসে পরীক্ষিৎ অভিমন্যুর পুত্র, ব্রাত্যজনেরা তার গা থেকে বস্ত্র খুলে নেয়, নিজেদের রক্তমাখা হাত দিয়ে তার সর্বাঙ্গে এঁকে দেয় রক্তচিহ্ন। পরীক্ষিৎ তখন যেন হয়ে ওঠে আমাদের এই দেশটা। সেই পরীক্ষিৎ দেখতে পায় দ্বারকার আরণ্যক বৃক্ষতলে শয়ান কৃষ্ণকে, তাকে ঘিরে ফেলেছে ব্যাধের দল ব্রাত্যজন বা প্রান্তিক বা নিম্নবর্গ যা-ই বলি না কেন তাদের। পরীক্ষিতের ও ভাবে কৃষ্ণকে দেখার থেকে ঋতুদার মনে হতে থাকে কৃষ্ণ আসলে গাঁধী। কৃষ্ণের মতোই দেশভাগ-দাঙ্গার অভিশাপ বইতে হয়েছিল গাঁধীকে, দু’জনেই অভিশপ্ত, দু’জনেই নিহত আততায়ীর হাতে।
তা হলে তো অর্জুনকে নেহরু ভাবতে হয়।
হ্যাঁ, তাই তো ভেবেছিল ঋতুদা। অর্জুন আর কৃষ্ণের সম্পর্ককে ওর এক দিক থেকে মনে হচ্ছিল নেহরু আর গাঁধীর সম্পর্ক। ঋতুদার এই ব্যাখ্যায় আমি একটা প্রখর ইতিহাসবোধ খুঁজে পেয়েছিলাম। পরিচালক হিসেবে এ আমার বড় প্রাপ্তি, আর এ সূত্রটাও আমার কাজে লেগে গেল।
কী রকম?
‘কালসন্ধ্যা’য় আগাগোড়া অর্জুনের কী ভীষণ নির্ভরতা কৃষ্ণের ওপর, অথচ সেই অর্জুনকেই আজ্ঞা করে কৃষ্ণ:
‘রাজকন্যা, রাজমাতা, রাজবধূ
সুভদ্রা, রুক্মিণী, সত্যভামা,
ষোড়শ সহস্র নারী,
শিশু, বৃদ্ধ, অসংখ্য সেবক,
আর স্বর্ণমাণিক্যের বিরাট ভাণ্ডার
সব নিয়ে যাত্রা করো তুমি।
গন্তব্য হস্তিনাপুর।’
রাজ্যপাট, দেশের মানুষের ভার নিতে বলে যেন সরে যায় কৃষ্ণ। দেশভাগ-স্বাধীনতার অব্যবহিতে নেহরু আর গাঁধীর সম্পর্কই মনে পড়ে যায় না কি?
কৃষ্ণহত্যাকে তা হলে গাঁধীহত্যার সঙ্গে মেলাচ্ছ?
ব্যাধের দল কৃষ্ণকে ঘিরে ধরে শর সংযোজন করছে, আর অবিচলিত কৃষ্ণ তার ঝোলা থেকে বাঁশি বের করছে বাজাবে বলে। যে মুহূর্তে ব্যাধেরা শর নিক্ষেপ করে, অফ-ভয়েস-এ গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। মহাকাব্যের হত্যা হয়ে ওঠে ইতিহাসের হত্যা।
কিন্তু এই উগ্রপন্থা তো তর্কাতীত নয়।
নিশ্চয়ই। আমার নাটকে কোথাও উগ্রপন্থাকে সমর্থন জানানো হচ্ছে না। কিন্তু এটাও তো অস্বীকার করা উপায় নেই যে উগ্রপন্থার উত্থান অবশ্যম্ভাবী ছিল। গাঁধীহত্যা ঘৃণ্য অবশ্যই, কিন্তু সে দিনের ভয়ংকর ভারতবর্ষে তো তেমনই এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আজও কি তার থেকে মুক্ত আমরা? এ বিষয়ে আমার আর ঋতুদার কোনও মতদ্বৈধ ছিল না।
উপস্থাপনায়, শরীরী ভাষ্যে তোমার ‘কালসন্ধ্যা’য় ঋতু যে ভাবে কৃষ্ণের মধ্যে ক্ষমতা ও পৌরুষের বিকল্প এক চরিত্র বুনে দিতে চাইছিল, খুঁটিয়ে দেখলে গাঁধীর হাঁটা চলা কথা বলার মধ্যেও কিন্তু সেই কঠোর পৌরুষের বিকল্প এক মানুষকে খুঁজে পাই।
আরে হ্যাঁ, ঋতুদা তো চেয়েইছিল যে, এই নাটকে কৃষ্ণের বডি-ল্যাঙ্গোয়েজ হবে গাঁধীর মতো। আমাকে বলেছিল: যখনই কোনও দৃশ্যে বসতে হবে, বলবি, দু’টো পা এক দিকে করে বসব গাঁধীর মতো।
কত নতুন ভাবে ভাবতে পারত!
অথচ কত তাড়াতাড়ি চলে গেল... |
|
|
|
|
|