|
|
|
|
এনডিএ ছাড়ার পথে নীতীশ, দূত মহাকরণে |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী যখন বিজেপির প্রধান মুখ হতে চলেছেন, ঠিক তখনই বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। প্রকাশ্যে ঘোষণা না করলেও পটনায় এক বৈঠকে দলীয় নেতাদের নীতীশ জানিয়ে দিয়েছেন, বিজেপির যেমন নরেন্দ্র মোদীকে তুলে ধরার দায় রয়েছে, ঠিক তেমনই ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জেডিইউ-এর পক্ষেও এনডিএ পরিত্যাগ করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
জোটের এই ভাঙন ঠেকাতে আজ বিজেপির প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী ফোন করেন নীতীশকে। অনুরোধ করেন ২০১৪ সাল পর্যন্ত জোটে থেকে যাওয়ার। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেডেরাল অ-কংগ্রেসি অ-বিজেপি জোট গঠনের সঙ্গী হতে চাইছেন নীতীশ। যেখানে আপাতত তাঁদের পাশে রয়েছেন আরও এক পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কও। নতুন এই জোট গঠনের লক্ষ্য নিয়েই নীতীশ আজ তাঁর দূত তথা দলের মহাসচিব কে সি ত্যাগীকে মমতার কাছে পাঠান। নীতীশের সঙ্গে ফোনেও আজ কথা হয় মমতার। নবীনের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, আজ মমতা, নীতীশের সুর ধরে দিল্লিতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সরব হয়ে নিজের রাজ্য ওড়িশার জন্য বিশেষ মর্যাদার দাবিতে সরব হয়েছেন নবীন। এর পাশাপাশি এ দিন মুলায়ম সিংহের কাছেও বার্তা পাঠান মমতা, যাতে ইউপিএ জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসেন সপা প্রধান। |
|
কে সি ত্যাগীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার মহাকরণে। —নিজস্ব চিত্র |
বিজেপির সঙ্গ ছাড়লেও কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোর কোনও পরিকল্পনা আপাতত নেই নীতীশের। বরং পূর্বাঞ্চলের তিনটি রাজ্যকে জোট বেঁধে লড়ার যে ডাক দিয়েছেন মমতা, তাতে সাড়া দিয়ে লোকসভা ভোটে কংগ্রেস ও বিজেপিকে বেগ দেওয়াই তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। আজ কলকাতায় তাঁর দূত কে এস ত্যাগী প্রায় আধ ঘণ্টা বৈঠক করেন মমতার সঙ্গে। মহাকরণে সেই বৈঠক শেষে মমতা বলেন, “ত্যাগীজি আমার সঙ্গে নীতীশ কুমারের ফোনে কথা বলিয়ে দিয়েছেন। আমি বলেছি, আমাদের মধ্যে একটি ফেডেরাল ফ্রন্ট গড়লে ভাল হবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এ ধরনের ফ্রন্ট দেশের এবং রাজ্যগুলির পক্ষে ভাল। নীতীশ আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন।” ফোনে মমতা নীতীশকে বলেন, “এখন কেন্দ্রে অ-কংগ্রেসি এবং অ-বিজেপি সরকার গড়ার সময় এসেছে। আমাদের একসঙ্গে বসে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।” জেডিইউ সূত্রের মতে, মমতার প্রস্তাবে একমত হয়েছেন নীতীশ।
নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গেও কথা বলেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “নবীন ছাড়াও আমার সঙ্গে বাবুলাল মরান্ডির কথা হয়েছে। নবীনজি আমাকে বলেছেন, উনি আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চান। কবে করবেন, তা উনি পরে জানাবেন।” তাঁর মতে, “আমরা অ-কংগ্রেসি এবং অ-বিজেপি জোট গড়তে চাইছি। আমাদের আলোচনা চলছে। আরও আলোচনা হবে।”
এনডিএ যে আবার ভাঙছে, তা মোটামুটি নিশ্চিত। আসলে বিজেপি যে ভাবে মোদীকে নিয়ে এগিয়েছে, সেখান থেকে তাদের পক্ষে পিছিয়ে আসা মুশকিল। আবার নীতীশও যে ভাবে মোদী-বিরোধিতায় আক্রমণাত্মক হয়েছেন, তাতে তাঁর পক্ষেও পিছু হটা সম্ভব নয়। আগামিকাল পূর্ব ঘোষণা মতো ‘সেবা যাত্রা’য় কাটিহার যাচ্ছেন নীতীশ। সেখান থেকে ফেরার পরেই সপ্তাহ শেষে জোট প্রসঙ্গে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে দল। ইতিমধ্যেই ১৫ জুনের পর সমস্ত সরকারি অনুষ্ঠান বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন নীতীশ। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “জোট ভেঙে গিয়েছে। কেবল আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি। তা ছাড়া জোট ভাঙার আগেই যে ভাবে বিজেপি নেতারা জেডিইউ নেতৃত্বের বিরোধিতায় সরব হয়েছেন, তা মোটেই ভাল ভাবে নিচ্ছে না দল।”
আসলে বিহারে জোট ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই সুর চড়াতে শুরু করেছেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। রাজ্য বিজেপি নীতীশ বিরোধিতার সুর চড়িয়ে এখন বিরোধী বেঞ্চে বসতেও রাজি বলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানিয়ে দিয়েছে। আগামী অক্টোবরে রাজ্যে ‘হুঙ্কার র্যালি’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিজেপি। সেই সমাবেশে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন মোদী। কিন্তু রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব এখন চাইছেন, দলের কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করতে তার আগেই মোদী বিহারে আসুন। যাতে মোদী-ঝড়ে খানখান হয়ে যায় নীতীশ কুমারের ঘর। তাঁদের আশা, বিহারে নীতীশের অনগ্রসর ভোটেও থাবা বসাতে পারেন মোদী। বিষয়টি নিয়ে মোদীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন বিহার বিজেপির সভাপতি মঙ্গল পাণ্ডে। এই পরিস্থিতিতে আজ নীতীশকে ফোন করেন আডবাণী। ফলে তাতে কাজ হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। অনেকে আবার বলছেন, শরিকি সঙ্কটের ওই ঘোলা জলে মাছ ধরতে তৎপর হয়েছেন আডবাণী। রাজ্যে জোট ভেঙে ২৪৩ আসনের বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে নীতীশের দরকার মাত্র চার বিধায়কের সমর্থন। যা তিনি কংগ্রেস বা নির্দল বিধায়কদের কাছ থেকে সহজেই পেয়ে যাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
একই আগ্রহ রয়েছে মমতার পক্ষ থেকেও। তিনি মনে করেন, পূর্বাঞ্চলের তিনটি রাজ্য জোট বেঁধে লড়ে কংগ্রেস ও বিজেপিকে ভাল মতই বেগ দেওয়া যাবে। তিন রাজ্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির লক্ষ্যে তাই কলকাতায় একটি মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনও আয়োজন করার কথা ভাবছেন মমতা। যার মূল ভিত্তি হবে অঞ্চলের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা। এ দিন মমতা ফোনে নীতীশকে জানান, তিনি মোটেই প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করা। নীতীশও তৃণমূল নেত্রীকে জানান, যে তিনিও প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। কেন না, এখনও সেই সময় আসেনি। আগে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির একটি জোট গড়ে তোলা হোক। নির্বাচনের ফলাফল দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।
মমতার ওই ফেডেরাল ফ্রন্টের তত্ত্বকে আজ আবার খারিজ করে দিয়েছে সিপিএম নেতৃত্ব। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, “হাস্যকর ব্যাপার! উনি (মমতা) কবে ফেডেরাল হলেন, জানি না। উনি পুরোপুরি ইউনিটারি (এককেন্দ্রিক)।” সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছেন, লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সরকার গড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে নীতীশ সে দিকে ঝুঁকে পড়বেন। আর নবীন?
তিনি আজ লক্ষ্যণীয় ভাবে বিজেপি সম্পর্কে নীরব। রাজ্যে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস। তাই বিজেপির দিকে ফের ঝোঁকার সম্ভাবনা রয়েছে নবীনের। সম্প্রতি নির্বাচনে একক ভাবে লড়ে খারাপ ফল করেছে তাঁর দল। ফলে দলের একটি অংশ আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধার বিষয়ে সক্রিয় রয়েছে। যদিও নীতীশের মতো নবীনও গত কাল জানিয়ে দিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদী কোনও ভাবেই জাতীয় স্তরে গ্রহণযোগ্য নেতা নন। নীতীশ বা নবীন সুযোগ পেলে যে কংগ্রেস বা বিজেপির মতো বড় দলগুলির দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন, তা বিলক্ষণ জানেন মমতা। তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্য, কোন দল ভবিষ্যতে কী করবে তা তাদের ব্যাপার। আপাতত সব থেকে আগে প্রয়োজন এমন আঞ্চলিক দলের জোট, যারা কংগ্রেস ও বিজেপি দু’দলের সঙ্গে সমদূরত্ব রেখে চলতে চাইছে। ত্যাগীর মহাকরণ সফরকে সেই লক্ষ্যেই বড় পদক্ষেপ বলে মনে করছে তৃণমূলের একাংশ।
|
পুরনো খবর: মমতার ফ্রন্ট গড়ার ডাকে সাড়া নবীন-নীতীশের |
|
|
|
|
|