যারা ছিল ‘বাড়ির মেয়ে-বউ,’ তাদের সমাজের মূলধারায় এনে ‘নাগরিক’ করে তোলার একটা উদ্যোগ এ রাজ্যে নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। শুরু হয়েছিল গরিব মেয়েদের স্বনির্ভর দলের প্রকল্প। আজ রাজ্যে স্বনির্ভর দল রয়েছে অন্তত ৯ লক্ষ। যার অর্থ, এক কোটিরও বেশি গ্রামের মেয়ে যুক্ত স্বনির্ভর দলের সঙ্গে। রাজ্যে দুই কোটি গৃহস্থালীর প্রায় দেড় কোটি রয়েছে গ্রামে। তাই ধরে নেওয়া চলে, অর্ধেকরও বেশি গ্রামীণ পরিবারের কোনও না কোনও মহিলার সংযোগ রয়েছে স্বনির্ভর দলের সঙ্গে।
এঁদের মধ্যে যারা অতি দরিদ্র, সেই মহিলাদের স্বনির্ভরতার পথ দেখানোর কাজ গ্রাম পঞ্চায়েতের। প্রায় ৪৮ লক্ষ বিপিএল মহিলাদের নিয়ে তৈরি চার লক্ষের মতো দলের সহায়তা করে পঞ্চায়েত। ‘স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনা’-র অধীনে তৈরি এই দলগুলি (এখন ‘আনন্দধারা’ প্রকল্প) ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পায়, ঋণ শোধ করার ক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি পায়, রোজগারের জন্য প্রশিক্ষণও পায়। আশা ছিল, মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাঙ্কের আদর্শ অনুসরণ করে গ্রামের গরিব মেয়েরা আর্থিক স্বর্নিভরতা আর সামাজিক মর্যাদা, দুই-ই পাবে।
সেই আশা কতটা পূরণ করতে পেরেছে গ্রাম পঞ্চায়েত?
তরাই মহিলা সমিতির মিতালি ঘোষ স্পষ্টই বললেন, “প্রকল্পের টাকা নষ্টই হচ্ছে। রিভলভিং ফান্ড এবং ব্যাঙ্ক ঋণ আদায় হয়ে যাওয়ার পরেই সব উদ্যোগে ভাটা পড়ে। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে গোষ্ঠীগুলি ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারছে কিনা তা আর দেখা হয় না। ফলে অধিকাংশ গোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়ে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকল্পটি গড়া হয়েছিল অর্থাৎ গোষ্ঠীর সদস্য গরিব মেয়েরা মাসে অন্তত দু’তিন হাজার টাকা রোজগার করবেন তা কার্যত মাঠে মারা গিয়েছে।”
পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, গরিব মেয়েদের গোষ্ঠীগুলি চালানোর কাজটা গ্রাম পঞ্চায়েত নেহাত দায়সারা ভাবে করছে। সেলাই বা মুরগিপালন, যে বিষয়গুলিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তা আদৌ ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে লাভজনক হবে কি না, তা নিয়ে সদস্যরা মাথা ঘামান না। প্রশিক্ষণের পর গোষ্ঠীর সদস্যরা সেই পণ্য উৎপাদন করছেন কিনা, নিয়মিত ব্যাঙ্ক ঋণ শোধ করছেন কি না, তা-ও দেখা হয় না। ব্যাঙ্কের সঙ্গে নিয়মিত আদান-প্রদানে গরিব মেয়েদের যে সহায়তা প্রয়োজন, তা-ও দিচ্ছে না পঞ্চায়েতগুলি।
তা হলে কী করছেন গ্রাম পঞ্চায়েতের মহিলা সদস্যরা? তাঁদেরই তো বিষয়টি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে সজাগ হওয়ার কথা।
হাওড়ার শ্যামপুর ২ ব্লকের খারুবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান শিখা মণ্ডল বলেন, “গোষ্ঠী তৈরি করি ঠিকই, তবে দেখভাল করেন সরকার-নিযুক্ত রিসোর্স পার্সনরা। বিপিএল মেয়েদের দলগুলোর অবস্থা কী, আমি তা জানিও না।” মেয়েদের প্রয়োজন মেটানোর কাজে যে ফাঁক থেকে যাচ্ছে, তা স্বীকার করেও বীরভূমের দুবরাজপুর ব্লকের বালিগুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মালতী ঘোষ বলেন, “গোষ্ঠী চালাতে গিয়ে মেয়েদের এমন কিছু সমস্যা হয়, যা তাঁরা পুরুষ সদস্যদের কাছে বলতে পারেন না। মহিলারা পঞ্চায়েতে বেশি করে এলে তাঁদের সুবিধে হবে।”
কিন্তু ৩৩ শতাংশ মহিলা যা পারেননি, ৫০ শতাংশ তা পারবেন, এমন আশা আছে কি?
পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার স্বপন পাণ্ডা, মুর্শিদাবাদের কান্দির একটি সংস্থার কর্ণধার মাধবী হাজরা জানান, বেসরকারি সংস্থাগুলি চেষ্টা সত্ত্বেও সব দল দাঁড়াতে পারে না। যেখানে নিয়মিত নজরদারি নেই, সেখানে তা আরও কঠিন।
পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি ১ ব্লকের নয়াপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সুপ্রিয়া রায় অবশ্য দাবি করেন, “আমার এলাকায় প্রচুর এসজিএসওয়াই গোষ্ঠী আছে, অনেকে ব্যাঙ্ক ঋণও পেয়েছে।” কিন্তু গোষ্ঠীর মহিলারা গড়ে কত রোজগার করেন, তার উত্তরে তিনি বলেন, “সেটা বলতে পারব না।” কাঁথি ২ ব্লকের দাঁড়াপুল গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বসমুতী বরের পাশে বসেই তাঁর এলাকার একটি গোষ্ঠীর সদস্য রেবতী বর বললেন, “গাছের চারার প্রশিক্ষণ নিয়ে আমাদের গোষ্ঠী ঋণ নিলেও তা থেকে আমার রোজগার নেই।”
পুরুলিয়ার মানবাজার গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান অনুরূপা সেন বলেন, “স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির কাজকর্ম অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। যদি আগামী দিনে বেশি করে মহিলা আসেন, আশা করি কাজে গতি আসবে।”
বেশি মহিলা সদস্য বেশি গতি আনবে, তা কি আশা করা চলে? দীর্ঘদিন রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কাজ করছেন তরুণ দেবনাথ। তিনি বলেন, “বহু মেয়ে স্বনির্ভর দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর পঞ্চায়েতের সদস্য হচ্ছে। রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে এদের মধ্যে স্বনির্ভর দলের জন্য কিছু করার একটা ইচ্ছে থাকেই। তাই আরও বেশি মেয়ে এলে এক অর্থে সুবিধে হবে। কিন্তু এ রাজ্যের গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি এতটাই রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থাকে, যে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মে পরিবর্তন এনে স্বনির্ভরতার জন্য উদ্যোগ নেওয়া মহিলা সদস্যদের কাছে কঠিন থেকেই যাবে।” |