মহিলাদের জন্য এ বার পঞ্চায়েত ভোটে ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পঞ্চায়েতের কাজে বেশি করে মহিলাদের সামিল হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু প্রার্থী হয়েও মনোনয়ন তুলে নিতে বাধ্য হলেন দেবযানী নস্কর।
দেবযানী বাসন্তীর আরএসপি বিধায়ক সুভাষ নস্করের নাতনি। বাসন্তীরই চরাবিদ্যা পঞ্চায়েতের এ বারে আরএসপি প্রার্থী ছিলেন। তাঁর মতো আরএসপি-র আরও ১৩ জন প্রার্থীও শনিবার ওই পঞ্চায়েত ভোট থেকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এক জনের আজ, সোমবার মনোনয়ন প্রত্যাহার করার কথা।
কারণ হিসেবে তাঁদের অভিযোগ সন্ত্রাস।
এই সেই চরাবিদ্যা, যেখানে গত বারে নির্বাচনের দিন তিন জন আরএসপি প্রার্থী খুন হন। পরের দিন বোমার আগুনে পুড়ে যায় তৎকালীন সেচমন্ত্রী তথা আরএসপি বিধায়ক সুভাষ নস্করের বাড়ি। পুড়ে মারা যান তাঁর ভাইপোর স্ত্রী গৌরী নস্কর। সেই ঘটনায় অভিযুক্ত ছিল ফ্রন্ট শরিক সিপিএম। এ বার তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছে আরএসপি। আর সেই কারণেই প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিলেন বলে জানিয়েছেন সুভাষবাবু। প্রত্যাশিত ভাবেই সন্ত্রাসের অভিযোগ মানেনি তৃণমূল। |
চরাবিদ্যায় পুলিশের ক্যাম্প। —নিজস্ব চিত্র। |
চরাবিদ্যা পঞ্চায়েত এলাকায় মোট ১০টি গ্রাম। রবিবার দুপুরে কয়েকটি গ্রামে ঘুরে দেখা গেল, কাঁচা রাস্তায় বাইক-বাহিনীর দাপট। এক একটি বাইকে সওয়ার তিন জন করে যুবক। কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, কারও হাতে লাঠি। তারা প্রকাশ্যে কিছু করছে না। শুধু তীব্র গতিতে গ্রামের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশের গাড়ি ঢুকলেই লুকিয়ে পড়ছে। গ্রামগুলি থমথমে। মহিলা-পুরুষেরা বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলতে নারাজ। বেশির ভাগ বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ। আরএসপি-র অভিযোগ, ওই বাইক-বাহিনী তৃণমূলেরই। সন্দেশখালি এবং ক্যানিং থেকে তারা আসছে। মনোনয়নপত্র তোলার সময় থেকেই প্রার্থী ও প্রস্তাবকদের হুমকি, মারধর চলছে।
ওই পঞ্চায়েতের মোট ১৭টি আসন। আরএসপি-র ১৪ জন প্রার্থীর মধ্যে মহিলা ৮ জন। জুন মাসের গোড়া থেকেই নিরাপত্তার স্বার্থে প্রার্থীদের দলের জোনাল কমিটির কার্যালয়ে এনে রেখেছে আরএসপি। প্রার্থীদের না পেয়ে এই ক’দিন সমানে তাঁদের পরিবারের লোকজন বা আত্মীয়-স্বজনকে শাসানো হচ্ছে বলে অভিযোগ।
এই আবহেই আর ভোট নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না আরএসপি প্রার্থীরা। তাঁরা বলছেন, গত বার যে কাজটা সিপিএম করেছিল, এ বার সেটাই তৃণমূল করছে। আরএসপি প্রার্থী অরুণ বিশ্বাস ২৯ মে মনোনয়ন জমা দেন। পরের রাতে তৃণমূলের ১০-১২ জন বাড়িতে ঢুকে তাঁর তিন মাসের শিশুকে খুনের হুমকি দিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেয় বলে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছিলেন অরুণবাবু। সেই ঘটনায় পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতারও করে।
কিন্তু তাতে আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি অরুণবাবুর স্ত্রী মধুমিতার। তিনি বলেন, “প্রতি বার পঞ্চায়েত ভোট এলেই এই রকম সন্ত্রাস। এ ভাবে কী থাকা যায়? এখানে যেন কেউ আর মেয়ের বিয়ে না দেন।” দেবযানী এমএ পড়ছেন। তিনিও মনোনয়ন প্রত্যাহারের পরে এ দিন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মহিলাদের পঞ্চায়েতের কাজে সামিল হতে বলছেন। কিন্তু তাঁর দলের লোকেরাই যে অত্যাচার শুরু করেছে, তাতে আমি বলব এখানে প্রার্থী হলে মহিলারা বিপদে পড়বেন।” আজ, সোমবার যাঁর মনোনয়ন প্রত্যাহারের কথা, তিনি পঞ্চমী সর্দার। রবিবার তিনি বলেন, “চাপে পড়ে আমি তৃণমূলের লোকজনকে বলেছি, মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেব। তবু বারে বারে আমার বাড়িতে নজরদারি চালাচ্ছে ওদের বাইক-বাহিনী।”
শনিবার গ্রামে ঢোকামাত্র সুভাষবাবুকে ঘিরে ধরেন দলের নেতা-কর্মীরা। সকলেই তাঁর কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। সুভাষবাবু বলেন, “গত বারের মতো এ বারও যাতে পরিস্থিতি রক্তক্ষয়ী না হয়, সে কারণেই আমরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালাম।” সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন জেলা তৃণমূল সভাপতি চৌধুরীমোহন জাটুয়া। তিনি বলেন, “আমি তো সন্ত্রাসের কোনও খবর পাইনি। যতদূর জানি, বিয়ের অনুষ্ঠানে যে ভাবে লোকজন দল বেঁধে আসে, সে ভাবেই গিয়ে আরএসপি প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। এখন কী কারণে তাঁরা মনোনয়ন তুলে নিচ্ছেন, তা ওঁরাই জানেন।”
তবে, পঞ্চায়েত ভোটের মুখে চরাবিদ্যার পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ গ্রামবাসী যে তটস্থ, তা পুলিশও মেনে নিচ্ছে। এ দিনই চরাবিদ্যার অদূরে আমঝাড়ার ভারতী মোড়ে এক ডিএসপি-র নেতৃত্বে ক্যাম্প করেছে জেলা পুলিশ। ক্যাম্পে ৫০ জন পুলিশকর্মী, র্যাফ ও কমব্যাট ফোর্স থাকছে। দিনভর টহল চলবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তবু, আতঙ্ক কাটছে না চরাবিদ্যার। |