দিল্লি না পশ্চিমবঙ্গ, মহিলার উপর নারকীয় ও বিকৃতকাম অত্যাচারে কে এগিয়ে, বারাসতের কামদুনির ঘটনার পর তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল।
দ্বিতীয় বর্ষের ওই কলেজ-ছাত্রীকে যখন গণধর্ষণ করা হচ্ছে, তখন তাঁর সংজ্ঞাই ছিল না বলে পুলিশ এবং চিকিৎসকেরা জানতে পেরেছেন। ময়নাতদন্ত করে প্রাথমিক ভাবে চিকিৎসকেরা জেনেছেন, দেহে সাড় না-থাকা অবস্থাতেই তাঁকে অন্তত চার জন পরপর ধর্ষণ করে। ধর্ষণের আগে বাঁশ দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করেছিল দুষ্কৃতীরা। ওই আঘাতেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যান বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। সংজ্ঞাহীন ওই তরুণীর মুখে তাঁরই অন্তর্বাস ঠেসে দেয় দুষ্কৃতীরা। শুধু তা-ই নয়, চিকিৎসকেরা জেনেছেন, ওই ছাত্রীর ঋতুচক্র চলছিল। ছাত্রীর বাড়ির মহিলারা তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, শুক্রবার তিনি পেটে ব্যথা নিয়েই পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন।
|
ধর্ষণের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত আনসার আলি মোল্লা। বারাসত থানায়। —নিজস্ব চিত্র্র। |
দিল্লিতে চলন্ত বাসের মধ্যে তরুণীর উপর অত্যাচার বা গুড়িয়ার ঘটনার সঙ্গেই এই ঘটনার তুলনা চলতে পারে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা, বিভিন্ন অরাজনৈতিক মঞ্চ ও রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ মনে করছেন। ইতিমধ্যেই এসএমএস ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতে এ নিয়ে কথা শুরু হয়ে গিয়েছে।
শুক্রবার রাতে তিন জনের পর শনিবার আরও তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, তাদের নাম সইফুল, নেপাল ও ভোলা। তারা কামদুনি লাগোয়া খড়িবাড়ি এলাকার বাসিন্দা। পুলিশের বক্তব্য, যে-ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই ঘটনার সময়ে পাঁচিল ঘেরা ওই কারখানার ভিতরে চোলাই বা গাঁজা খাচ্ছিল। তবে তদন্তকারীদের সন্দেহ, মোট সাত জন ছিল ওই আড্ডায়। উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার সুগত সেন বলেন, “এখনও পর্যন্ত ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা আরও এক জনের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছি।”
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, গোটা ঘটনাটি কী ভাবে ঘটল, ধৃতদের জেরা করে এ দিন তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। তদন্তে জানা গিয়েছে, পরীক্ষা দিয়ে কলেজ থেকে বাসে চড়েছিলেন ওই কলেজ-ছাত্রী। বেলা আড়াইটে নাগাদ কামদুনি বাসস্ট্যান্ডে নেমে হেঁটেই তিনি বাড়িতে ফিরছিলেন। কারখানার উঁচু পাঁচিল ঘেরা জায়গা পেরোনোর সময়েই তিনি দুষ্কৃতীদের খপ্পরে পড়েন। দুষ্কৃতীরা তাঁকে টেনে কারখানার চৌহদ্দির ভিতর ঢুকিয়ে লোহার বিশাল দরজা বন্ধ করে দেয়। ছাত্রীটি চিৎকার করতে থাকেন। লোহার ফটকের সামনেই পড়ে ছিল বড় একটি বাঁশের টুকরো। দুষ্কৃতীদের এক জন ওই বাঁশ দিয়ে ছাত্রীটির মাথায় মারে। সেই আঘাতেই জ্ঞান হারান তরুণী। এর পর আর তাঁর সংজ্ঞা ফেরেনি। ওই লোহার ফটকের সামনেই তাই অনেকটা রক্ত পড়েছিল বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। গোটা ঘটনায় ওই জমির কেয়ারটেকার আনসার আলি মোল্লার প্রধান ভূমিকা ছিল বলে তদন্তকারীদের দাবি। দশ বছর আগে মুক্তি পাওয়া দক্ষিণ কোরীয় ছবি ‘মেমোরিজ অফ মার্ডার’-এর সঙ্গে কামদুনির বাস্তব ঘটনাস্থল এবং চিত্রনাট্যের মিল পাচ্ছেন তাঁরা।
অটোপসি সার্জেনদের বক্তব্য, ‘ড্রাই সাফোকেশন’-এর কারণেই ওই কলেজ-ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ধর্ষণের পরে ওই অবস্থাতেই তাঁকে হত্যা করা হয়। তাই ছাত্রীর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোনো বা অন্য কোনও বিকৃতির চিহ্ন মেলেনি বলে চিকিৎসকেরা মনে করছেন। তদন্তকারীরা জেনেছেন, ধর্ষণের পর একই সঙ্গে দু’জন দু’দিক থেকে ওই ছাত্রীর দু’পা দু’দিকে টেনে চিরে ফেলে। তৃতীয় এক জন দুষ্কৃতী তাঁর গলা টিপে ধরে। তবে চিকিৎসকের সন্দেহ, ধর্ষণের সময়েই সম্ভবত ওই ছাত্রী মারা যান। তদন্তকারী এক অফিসারের কথায়, “ধর্ষণের সময়ে তরুণীর জ্ঞানই ছিল না। সেই অবস্থাতেও তাঁকে ধর্ষণ করে অন্তত চার জন দুষ্কৃতী। এটা অপরাধীদের বিকৃত মানসিকতারই পরিচয়।”
বারাসতের প্রাক্তন বিধায়ক ও ফরওয়ার্ড ব্লক নেত্রী বীথিকা মণ্ডল শুক্রবারই ওই ছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে তাঁর পরিবারের মহিলাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর কথায়, “ওই ছাত্রীর মা ও জেঠিমার সঙ্গে কথা বলে ওঁর শারীরিক অবস্থা ও অত্যাচারের স্বরূপ জানতে পারি। তার পর থেকে আমি ঘুমোতে পারছি না। আমার মনে হয়, দিল্লির ঘটনার চেয়েও কামদুনির এই ঘটনা অনেক বেশি নারকীয়।”
রবিবার ওই ছাত্রীর বাড়িতে যান নারী নির্যাতন বিরোধী নাগরিক কমিটি এবং শিল্পী-সাংস্কৃতিক-কর্মী-বুদ্ধিজীবী মঞ্চের প্রতিনিধিরা। তাঁদের পক্ষে শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় বলেন, “অবধূতের ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’ উপন্যাসে বিকৃতকাম, যৌন নির্যাতনের কথা রয়েছে। কিন্তু সে তো বহু দিন আগের প্রেক্ষাপটে লেখা। বারাসতের ওই ঘটনা তাকেও হার মানিয়ে দেয়। এখনকার সমাজেও যে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে, সেটাই উদ্বেগের।”
কেন এমন হচ্ছে? মনোবিদ সত্যব্রত কর বলেন, “নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অপরাধ করলে তার নৃশংসতা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। আর মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যায়, কেউ একা অপরাধ করলে, দ্বিধা থাকতে পারে। কিন্তু দলবদ্ধ অপরাধের ক্ষেত্রে সে সব লোপ পায়।” আক্রান্ত ব্যক্তিটির সঙ্গে শত্রুতা থাক বা না থাক, তাকে নির্যাতন করে শেষ করে ফেলতে হবে, এই মনোভাবটাই বড় হয় বলে জানান সত্যব্রতবাবু।
ঘটনার এই নৃশংসতাই কার্যত স্তব্ধ করে দিয়েছে কামদুনি এলাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে। অধিকাংশ বাড়িতেই হাঁড়ি চড়ছে না। মধ্যমগ্রাম বিবেকানন্দ কলেজের ছাত্র সন্দীপ ঘোষ বলেন, “আমাকে ও মামা বলে ডাকত। শুক্রবার রাতে খাবার ফেলে ছুটে গিয়েছিলাম। তার পর থেকে খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছে।” রান্না বন্ধ বাপি মণ্ডল, ভজু নস্করদের বাড়িতেও। তাঁদের বক্তব্য, “রান্না করবে, এমন কেউ বাড়িতে নেই। সবাই রাস্তায় নেমেছে।” |