জনরোষের কামদুনি তৃণমূলেরই গড়
তৃণমূল ছাড়া আর কোনও দলের কার্যত অস্তিত্বই নেই। শাসক দলের একাধিপত্য এতটাই প্রবল যে নির্বাচন হওয়ার আগেই আস্ত গ্রাম পঞ্চায়েতটা দখলে চলে এসেছে তৃণমূলের। দ্বিতীয় বর্ষের কলেজ ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় বারাসত-২ নম্বর ব্লকের যে জনপদ শিরোনামে, সেই কামদুনি আসলে কীর্তিপুর-২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। ওই গ্রাম পঞ্চায়েতে এ বার মোট আসন ১২। তার মধ্যে ১১টি আসনেই সিপিএম তথা বামফ্রন্ট প্রার্থী দিতে পারেনি। তৃণমূল প্রার্থী দিয়েছে সব ক’টি আসনে। ফলে বিডিও অফিসে মনোনয়নপত্র স্ক্রুটিনি হওয়ার দিন, গত শুক্রবারই বোঝা যায়, শাসক দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম হয়ে গিয়েছে কীর্তিপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতে। কাকতালীয় ভাবে সে দিন দুপুরেই দ্বিতীয় বর্ষের সেই কলেজ-ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয় কামদুনি বাসস্ট্যান্ডের ৪০০ মিটারের মধ্যে।
বারাসতের কামদুনি এলাকায় চলছে পুলিশের টহলদারি। রবিবার।—নিজস্ব চিত্র।
ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ধৃতদের অন্যতম আনসার আলি মোল্লা শাসক দল তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ বলে গোড়াতেই অভিযোগ তোলেন এলাকার মানুষ। এ দিন সেই অভিযোগ তোলেন বিরোধীরাও। উত্তর ২৪ পরগনার জেলা পরিষদ সদস্য, বারাসত-২ নম্বর ব্লকের সিপিএম নেতা কুতবউদ্দিন আহমেদ বলেন, “শুক্রবার ছিল বিডিও অফিসে স্ক্রুটিনির দিন। কিছু ক্ষণের মধ্যেই বোঝা যায়, কীর্তিপুর-২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত ভোট পড়ার আগেই তৃণমূলের দখলে চলে এসেছে। আমরা ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের মাত্র একটি আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছি। কীর্তিপুর অঞ্চলের তৃণমূল আশ্রিত সমাজবিরোধীরা মোটরসাইকেলে করে বিডিও অফিসে এসেছিল। তার পর পঞ্চায়েত দখল করার আনন্দে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে সব ওই ভেড়ি এলাকায় মদের ঠেকে বসেছিল। ওরাই ওই কলেজ-ছাত্রীর উপর নৃশংস অত্যাচার করেছে।” তৃণমূলের কীর্তিপুর-২ নম্বর অঞ্চল সভাপতি আসরাফ আলি মোল্লা অবশ্য বলেন, “দুষ্কৃতীদের দল হয় না। ধৃতেরা আমাদের দলের কেউ নয়।”
কিন্তু যেখানে শাসক দলের এমন একচ্ছত্র দাপট, সেখানে চোলাইয়ের ঠেক, মহিলাদের সম্মানহানির মতো অপরাধমূলক কাজকর্ম দিনের পর দিন ঘটলেও শাসক দল এত দিন চুপ ছিল কেন? বিব্রত আসরাফের দাবি, “আমরা জানতাম না, ওখানে এই সব চলছে।”
ক্ষোভ কমাতে চার প্রতিশ্রুতি
এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর্বে এলাকায় তৃণমূলের সর্বগ্রাসী শক্তি অবশ্য নেতার ওই অজ্ঞতার দাবির সঙ্গে মিলছে না। বারাসত-২ নম্বর ব্লকে এ বার গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট আসনসংখ্যা ১৩৩। তৃণমূল সব ক’টিতেই প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। সিপিএম তথা বামফ্রন্ট প্রার্থী দিতে পারেনি ২৬টি আসনে, যার মধ্যে রয়েছে কীর্তিপুর-২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের ওই ১১টি আসন। উপরন্তু সিপিএমের স্থানীয় নেতৃত্ব বলছেন, আরও অন্তত ৫০টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসন থেকে শেষ পর্যন্ত প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিতে হবে। সিপিএম নেতৃত্বের অভিযোগ, ইতিমধ্যেই ওই প্রার্থীদের অনবরত হুমকি দেওয়া হচ্ছে, অনেককে মারধরও করা হয়েছে। ভাঙচুরও চালানো হয়েছে কারও কারও বাড়িতে। বারাসত-২ নম্বর ব্লকে তাঁদের দেড়শো কর্মী গ্রামছাড়া বলে অভিযোগ সিপিএমের।
আসলে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে তাল মিলিয়েই উত্তর ২৪ পরগনার ওই ভেড়ি এলাকার রং পাল্টে গিয়েছে। এক সময়ে যে ভেড়ি এলাকায় সিপিএম-ই ছিল শেষ কথা, সেখানে সব কিছুই এখন তৃণমূলের অঙ্গুলি হেলনে চলছে। ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে কীর্তিপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট ১০টি আসনের মধ্যে সিপিএম ছ’টি ও তৃণমূল চারটি আসন জিতেছিল। পরবর্তী সময়ে, ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর সিপিএমের দু’জন সদস্য তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় ওই গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূলের দখলে আসে। আসরাফের স্ত্রী সাইদা বিবি হন পঞ্চায়েত প্রধান। একই ভাবে সে বার বারাসত-২ নম্বর ব্লকের মোট ১১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে বামফ্রন্ট পেয়েছিল ৬৮টি ও তৃণমূল পেয়েছিল ৪২টি আসন। এ বার ভোটের আগেই ছবিটা স্পষ্ট। এলাকার সমাজবিরোধীরাও পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিজেদের আনুগত্য পাল্টেছে।
কামদুনি গ্রামের এক বাসিন্দার কথায়, “এখানে এখন তৃণমূল ছাড়া কেউ নেই। তাই ভাল-মন্দ, সব দায় শাসক দলকেই নিতে হবে। আমাদের গ্রামের ওই ছাত্রীকে নৃশংস ভাবে শেষ করে দেওয়া হল। তৃণমূলের লোকজনই যে এই পরিস্থিতিতে মানুষের রোষে পড়বেন, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার।”
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শাসক দলের উপরের সারির নেতারা জনরোষের বিষয়টি বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন। তাই এখন চলছে ক্ষোভ প্রশমনের নানা চেষ্টা, দগদগে ক্ষতের উপর মলম লাগানোর প্রয়াস।
রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে শনিবার ক্ষিপ্ত জনতা গ্রামেই ঢুকতে দেয়নি। এলাকার মানুষের ক্ষোভ কমাতে তিনি ছাত্রীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। তাতে ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়েছিল। ভাঙচুর হয় সাংসদ নুরুল ইসলামের গাড়িও। রবিবার, ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পরেও শাসক দলের কেউ ওই গ্রামে যাওয়ার সাহস দেখাননি। মধ্যমগ্রামে জেলা তৃণমূল পার্টি অফিসে এ দিন জ্যোতিপ্রিয়বাবু ওই ছাত্রীর দাদাকে ডেকে পাঠান। তিনি ও কামদুনির কয়েক জন বাসিন্দা জ্যোতিপ্রিয়বাবুর কাছে দাবি করেন, তাঁদের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে দিতে হবে।
ওই ছাত্রীর মৃতদেহ নিয়ে শনিবার রাতেই কামদুনির বাসিন্দারা কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে যাবেন বলে গোঁ ধরেছিলেন। তাঁদের জন্য নিমতলা ঘাট শ্মশানে ডিসি (বন্দর)-র নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী পাঠাতে হয়। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনেও রাত দেড়টা পর্যন্ত পুলিশের বিশাল বাহিনী মোতায়েন রাখা হয়েছিল। এ দিনও জ্যোতিপ্রিয়বাবুর কাছে একই দাবিই জানাতে থাকেন কামদুনির বাসিন্দারা। ক্ষোভ প্রশমনে জ্যোতিপ্রিয়বাবু পরে তাঁদের জানান, মুখ্যমন্ত্রী বুধবার বিকেল চারটেয় তাঁদের সঙ্গে মহাকরণে দেখা করবেন।
ক্ষোভ প্রশমনের আর এক ধাপ হিসেবে জ্যোতিপ্রিয়বাবু এ দিন জানান, কামদুনিতে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প তৈরি হয়ে গিয়েছে। যদিও এ দিন সেখানে গিয়ে সেই ক্যাম্পের কোনও চিহ্ন মেলেনি। তবে এসডিপিও-র নেতৃত্বে পুলিশি টহলদারি চলছে এবং রয়েছে পুলিশ পিকেট। জেলার এসপি সুগত সেন বলেন, “স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের জন্য আগে জমির প্রয়োজন। সেটা আগে নির্দিষ্ট করতে হবে। জমি পাওয়া গেলে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প তৈরি করায় সমস্যা হবে না।”
কামদুনি-মধ্যমগ্রাম বিডিও অফিস সড়কে একেই দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্য, তার উপর এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি, ওই রাস্তায় বিদ্যুতের খুঁটি বসানোর বিষয়টিও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। রবিবার পর্যন্ত বিদ্যুতের একটি খুঁটিও অবশ্য ওই রাস্তায় পড়েনি। এলাকার মানুষের বক্তব্য, “এক দিনের জন্য করলে হবে না। আমরা স্থায়ী ভাবে সমস্যার সমাধান চাই। বিদ্যুদয়ন, নিরাপত্তা, শান্তিশৃঙ্খলা চাই।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.