প্রায় নিঃশব্দে গত হইল ৪ জুন, ১৯৮৯-এর ২৪তম বার্ষিকী, যে দিনটিতে বেজিংয়ের তিয়েনানমেন স্কোয়ারে গণতন্ত্রকামী ছাত্রদলের উপর কমিউনিস্ট চিনের সাঁজোয়া বাহিনীর আক্রমণ নামিয়া আসিয়াছিল। স্থানীয় সমর্থকদের ব্যারিকেড ও প্রতিরোধ নির্মম ভাবে দমন করিয়া গণ-ক্ষমতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রদর্শনীকে রক্তস্নানে প্লাবিত করিয়াছিল চিনা ‘গণমুক্তিফৌজ’! কেবল তিয়েনানমেন স্কোয়ারের আশপাশেই নিহত হইয়াছিলেন অন্তত আড়াই হাজার মানুষ। সাংহাই-সহ দেশের চারশোটি শহরে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার দাবিতে আরও যে লক্ষ লক্ষ ছাত্রযুবক বিক্ষোভে শামিল হইয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা যায় না। এই ভয়াবহ ঘটনার মূল্যায়ন দূরস্থান, তাহা লইয়া যাবতীয় আলোচনা ও উল্লেখকেও নিষিদ্ধ করে চিনা সরকার।
মহাশক্তিধর চিনা কমিউনিস্ট পার্টি তিয়েনানমেন স্কোয়ারের ঘটনাকে এতই ভয় পায় যে, গণমাধ্যম হইতে ইন্টারনেট, সর্বত্র এই বিষয়ে আলোচনা নিয়ন্ত্রণ করা হইয়াছে। ইন্টারনেটে এমনকী জ্বলন্ত মোমবাতির ছবিকেও এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতারা ভয় পাইতেছেন। অথচ আজকের চিন মোটেই ১৯৮৯ সালের চিন নয়, যখন মাও জে-দং-উত্তর আর্থিক সংস্কারের সহিত তাল মিলাইতে গিয়া দেশ তীব্র সঙ্কটে নিমজ্জিত হইয়াছিল, মূল্যবৃদ্ধি ত্রিশ শতাংশে পৌঁছাইয়াছিল এবং দশ লক্ষ কারখানা বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন মিখাইল গোর্বাচেভের ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রইকা’র অভিযান চলিতেছে। চিনের ছাত্রযুব সমাজেও তাহার অভিঘাতে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ অমোঘ হইয়া ওঠে। পার্টি নেতৃত্বও উদারনীতিক ও রক্ষণশীলদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত হইয়া যায়। তদবধি চিনের ইতিহাস হইতে তিয়েনানমেন স্কোয়ারের সংগ্রামকে মুছিয়া দেওয়া হইয়াছে। জর্জ অরওয়েলের ‘নাইন্টিন এইটি ফোর’ মনে পড়ে।
১৯৮৯-এর কমিউনিস্ট নেতৃত্বই কিন্তু ১৯৯২-এর আর্থিক সংস্কারের হোতা। চিনের চমকপ্রদ উন্নয়ন যুগপৎ আর্থিক উদারনীতি ও রাজনৈতিক স্বৈরাচারের উপর দাঁড়াইয়া আছে। ইহার ক্ষণভঙ্গুরতাও সেই কারণেই। সম্ভবত সে জন্যই কমিউনিস্ট নেতৃত্ব জনসাধারণের স্মৃতিকে ভয় পায়। সাহিত্যিক মিলান কুন্দেরা বলিয়াছেন, ‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম আসলে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই’। চিনা শাসকরা তিয়েনানমেনের স্মৃতির পুনরুজ্জীবনকে ভয় পান, তাই ওই ঘটনাকে বিস্মরণের অতলে তলাইয়া দিতে উদ্গ্রীব। গণতন্ত্রকামী চিনা জনগণ কিন্তু ওই স্মৃতিকেই জাগরুক রাখিতে উৎসুক। বিস্মৃতির সহিত স্মৃতির এই লড়াই স্বৈরাচারের সহিত গণতন্ত্রের লড়াইয়েরই রকমফের। প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ হংকংয়ে ৪ জানুয়ারির সন্ধ্যায় দেড় লক্ষ গণতন্ত্রকামী চিনা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে বেদনা ও উচ্ছ্বাসের সেই স্মৃতিকেই জাগাইয়া তুলিলেন, শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করিয়া। |