|
|
|
|
মেজাজে নম্র, ধর্মনিরপেক্ষ |
কংগ্রেস ভাগাও, প্রথম দিনই চড়া মেজাজে মোদী |
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • পানজিম |
নির্বাচনী প্রচার কমিটির দায়িত্ব পাওয়ার পর কালবিলম্ব না করে নিজের কাজে নেমে পড়লেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। ভোটের ঢাকে প্রথম কাঠিটি বাজিয়ে দিলেন আজ থেকেই।
কর্মসমিতির বৈঠকের পর গোয়াতে কর্মিসভায় মোদী আজ তাঁর নতুন দায়িত্বের পথনির্দেশিকাও বাতলে দিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য, কংগ্রেস-মুক্ত ভারত নির্মাণ। আর স্লোগান, কংগ্রেস ভাগাও। নিজেই বললেন, অটলবিহারী বাজপেয়ী যেখান থেকে শেষ করেছেন, সেখান থেকেই শুরু হবে তাঁর কাজ। দেশ থেকে কংগ্রেসকে উৎখাতের মন্ত্রই যে প্রকৃত জাতীয়তাবাদ, সেটাই সব সমস্যার সমাধান, সেই নির্দেশিকাই আজ দায়িত্ব নিয়ে এঁকে দিলেন গোটা দলের কাছে।
বিজেপি-তে অভ্যন্তরীণ কলহ এখনও মেটেনি। কিন্তু আজ দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সযত্নে সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন মোদী। তিনি জানেন, ভারতে কংগ্রেস ও বিজেপি, এই দু’টিই মূল রাজনৈতিক ধারা। এবং বিজেপি-র বৃদ্ধির শিকড় লুকিয়ে রয়েছে কংগ্রেস-বিরোধিতার মধ্যেই। অতীতে কংগ্রেস-বিরোধিতা মাথাচাড়া দিয়েছিল জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে। ১৯৮৯ সালে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের সময় আবার সেই আন্দোলন তীব্র হয়। কিন্তু ক্রমে বিজেপি-র শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে আবার শক্তিক্ষয়ও হয়েছে। শরিকরাও একে একে সঙ্গ ছেড়েছে। এই অবস্থায় লোকসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার করার জন্য মোদীকে যে কংগ্রেস- বিরোধিতা করেই গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন।
তাই কংগ্রেসের বিপক্ষে মোদী তাঁর নিজের মডেল তুলে ধরতে চাইছেন। সেই মডেলে সওয়ার হয়েই এখন এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে চান তিনি। দায়িত্ব পাওয়ার পর কী কৌশল নরেন্দ্র মোদীর? |
|
অভিষেকের পর। জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে মোদী। ছবি: পি টি আই |
প্রথমত, এক সময় হিন্দু হৃদয়-সম্রাট হলেও মোদী কিন্তু গত কয়েক বছরে নিজেকে ‘বিকাশপুরুষ’ হিসেবে মেলে ধরতে চেয়েছেন। আজ কর্মিসভায় ঘুণাক্ষরেও তাঁর মুখে উঠে আসেনি রামমন্দির, অযোধ্যার প্রসঙ্গ। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিও আর উচ্চারিত হয় না তাঁর মুখে। এমনকী, আজ রাতে গোয়া থেকে আমদাবাদ পৌঁছেও বিমানবন্দরে অগণিত সমর্থকের কাছে তিনি গুজরাতের উন্নয়নের মডেলই তুলে ধরেছেন। বিজেপি-র অন্তঃকলহের জেরে আডবাণীর নাম মুখে না আনলেও বারবার তিনি বাজপেয়ীর কথা উল্লেখ করেছেন। অটল-আডবাণীর জমানা পেরিয়ে এসে বিজেপি যখন মোদীময় হতে চাইছে, সেই সময় মোদীর মধ্যে দেখা যাচ্ছে দলের বাজপেয়ীকরণের চেষ্টা।
দ্বিতীয়ত, গোটা দেশের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে বিজেপি-র কাণ্ডারী এখন নিজের বিনম্র, ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিরও বিকাশ ঘটাতে চান। অটল-আডবাণীর নাম না করেই আজ তিনি বলেছেন, “প্রবীণরা আমাকে ঘষেমেজে তৈরি করেছেন। পরিবর্তিত করেছেন। হাতেকলমে সমস্ত কিছু শিখিয়েছেন। আমার যাবতীয় ত্রুটি দূর করার নিরন্তর চেষ্টা করে গিয়েছেন। নিজেদের সন্তানের থেকেও আমাকে বেশি সময় দিয়েছেন। কখনও কখনও মনে হয়, প্রবীণরা আমাকে এত শক্তি না জোগালে আজ আমি এই অবস্থায় পৌঁছতাম না।” স্পষ্টতই গোধরার কলঙ্ককে পিছনে রেখে মোদী নিজেকে অখণ্ড ভারতের প্রতিনিধি করে তোলার চেষ্টা করছেন। বার্তা দিচ্ছেন আগামী দিনে তিনি হাঁটতে চান ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের পথে।
তৃতীয়ত, কংগ্রেসের বিরোধিতা করে নিজেকে তাঁর বিকল্প হিসাবে তুলে ধরার প্রয়াস। সে কারণে মনমোহন সরকারের একের পর এক দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি ও অন্য ব্যর্থতার প্রসঙ্গ তুলে নিজের বিকল্প মুন্সিয়ানার পথ বাতলেছেন। তিনি ক্ষমতায় এলেই যে বেকারি, দারিদ্র কমবে, পরোক্ষে সে কথা বলতেও ভোলেননি। আর এই প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন মনমোহন সিংহকেও। বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নড়েন না, চড়েন না। যেন অবচেতনে থাকেন। কিন্তু তিনি কিছু বললেই মনমোহন সিংহের চেতনা ফিরে আসে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হলেও তিনিই যে দলের প্রধানমন্ত্রীর মুখ, সুকৌশলে সেই কথাই বোঝাতে চেয়েছেন বারবার। বলেছেন, “আমি যা ভাবতে পারি, মনমোহন সিংহ কেন তা ভাবতে পারেন না?” আক্রমণ করতে ছাড়েননি সনিয়া গাঁধীকেও। সনিয়ার দৌলতে মাওবাদী সমর্থকরা সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে জায়গা করে নিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীকে কার্যত অকেজো করে রেখেছেন, এই অভিযোগ করে নিশানা করেছেন কংগ্রেস সভানেত্রীকেও।
চতুর্থত, বিজেপি-র যে সব শরিক সঙ্গ ছেড়ে গিয়েছে, কংগ্রেসকে আক্রমণ করে তাদেরও বার্তা দিয়েছেন মোদী। কী ভাবে সিবিআইকে অ-কংগ্রেসি দলগুলির পিছনে লেলিয়ে দেওয়া হয়, তা বলে সম্ভাব্য শরিকদের মন জয়েরও চেষ্টা করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এনডিএ-র পুরনো শরিকও ওই একই অভিযোগ করে থাকেন। মোদী আজ সমস্ত অ-কংগ্রেসি দলেরই প্রতিনিধি হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। কংগ্রেসের জোট ধর্মের বাধ্যবাধকতার বুলি কটাক্ষ করে আসলে নিজেকেই অন্যদের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করতে চেয়েছেন।
খুব শীঘ্রই দেশ জুড়ে প্রচারের কাজ শুরু করে দেবেন মোদী। ১৭ জুন থেকে ২২ জুন পর্যন্ত বিজেপি দেশ জুড়ে জেল-ভরো আন্দোলন করবে। ছত্তীসগঢ়ের ঘটনার পর যেটি স্থগিত রাখা হয়েছিল। তার পর ২৭ জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোদী গোটা দেশে প্রচার শুরু করবেন। এর মধ্যে মূল জোর থাকবে গোবলয়েই। গুজরাতে সর্দার বল্লভভাই পটেলের যে বিশাল মূর্তি গড়তে চাইছেন মোদী, তার জন্য গোটা দেশের কৃষকের থেকেও সাহায্য চাইছেন। কৃষকদের হালের লোহা একত্রিত করেই এই মূর্তি গড়তে চান তিনি। যাতে এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের হাওয়ায় কৃষক সমাজকে একজোট করা যায় ও ভেস্তে দেওয়া যায় কংগ্রেসের ভারত-নির্মাণের প্রচারকে। মোদী বলেন, “কংগ্রেস বলে ভারত-নির্মাণ তাদের হক (অধিকার)। লোকে বলছে, সেটি হক নয়, ‘শক’ (সন্দেহ)। লোকে তাদের প্রচারকে সন্দেহ করছে। তাই আমার স্লোগান কংগ্রেস-মুক্ত ভারত নির্মাণ।” |
|
|
|
|
|