প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলেন বারাবনির প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক দিলীপ সরকার (৬৮)। রবিবার সকালে বর্ধমানের বার্নপুরে তাঁর বাড়ির অদূরেই সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দিলীপবাবুকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। আততায়ীরা এসেছিল মোটরবাইকে করে। তাদের একজন মহিলা বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। চালকের পিছনে বসে থাকা সেই সালোয়ার কামিজ পরা ওই মহিলাই পরপর গুলি ছুড়ে দিলীপবাবুকে খুন করে। তার মুখ ওড়নায় ঢাকা ছিল।
নিপাট ভালমানুষ হিসেবে পরিচিত এই প্রবীণ নেতাকে খুনের কারণ কী, সে ব্যাপারে পুলিশ অন্ধকারে। আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এডিসিপি (পশ্চিম) সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “আমরা একটি অভিযোগ পেয়েছি। তা থেকে জেনেছি, এক পুরুষ ও এক মহিলা মোটরবাইক আরোহী খুব কাছ থেকে দিলীপবাবুকে গুলি করেছে। এখনও কেউ ধরা পড়েনি। তল্লাশি চলছে। সব সম্ভাবনাই মাথায় রাখা হচ্ছে।” কোনও পুরুষ মহিলার পোশাক পরে এসেছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশ জানিয়েছে, দেশি আগ্নেয়াস্ত্র থেকেই গুলি করা হয়েছে। |
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আজ, সোমবার আসানসোলে ১২ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছে সিপিএম। পঞ্চায়েত ভোটের আগে এমন ঘটনায় তৃণমূলের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলেছে সিপিএম। দলের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারের দাবি, “দিলীপবাবুকে দলের তরফে এ বার ভোটে বারাবনির পঞ্চায়েতগুলি দেখাশোনার ভার দেওয়া হয়েছিল। সিপিএম-কে চাপে ফেলতেই তাঁকে খুন করা হল।” আসানসোলের তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটক ও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের যদিও দাবি, এই ঘটনা সিপিএমের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর পাল্টা মন্তব্য, “তৃণমূল নিজে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিদীর্ণ। তাই তারা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের নতুন সূত্র বের করছে!” তাঁর কথায়, “বাঁকুড়ায় কী ঘটেছিল? চার জন হাসপাতালে ভর্তি হননি? ব্যারাকপুরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হয়নি? এখন তাঁরা অন্য ঘটনায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের গন্ধ পাচ্ছেন!” ঘটনার নিন্দা করেছে সিপিএম পলিটব্যুরোও।
এ দিন ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিলোমিটার খানেক দূরে একটি ক্লাবের মাঠে হাঁটতে যান দিলীপবাবু। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল পৌনে ৭টা নাগাদ মাঠ থেকে মূল রাস্তা আপার রোডের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। সেই সময়ে একটি মোটরবাইকে চড়ে দু’জন তাঁর দিকে এগিয়ে আসে। চালকের আসনে থাকা পুরুষের মুখ হেলমেটে ঢাকা ছিল। পিছনের সিটে বসে থাকা ওই মহিলা দিলীপবাবুকে লক্ষ করে গুলি ছোড়ে। দু’টি গুলি লাগে তাঁর পেটে। গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই পালানোর চেষ্টা করেছিলেন দিলীপবাবু। কিন্তু খানিকটা দৌড়ে তিনি ইস্কোর একটি আবাসনের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে যান। পিছন থেকে তাঁকে তাড়া করে আসছিল আততায়ীরা। তিনি পড়ে গেলে ফের তাঁর পিঠেও দু’টি গুলি করা হয়। মোট চারটি গুলি লাগে দিলীপবাবুর গায়ে। এর পরে দুষ্কৃতীরা দ্রুত চম্পট দেয়।
ঘটনাস্থলের আশপাশে রয়েছে ইস্কোর কিছু আবাসন। দিলীপবাবু পড়েছিলেন কৌশিক দে নামে এক স্থানীয় বাসিন্দার বাড়ির সামনে। তিনি বলেন, “ঘটনায় আমরা চমকে উঠেছিলাম। গুলির শব্দে লোকজনও জড়ো হয়ে যায়। কিন্তু আশপাশে কোনও যানবাহন ছিল না। কয়লা নিয়ে যাওয়া একটি ভ্যান রিকশা থামিয়ে তাতে চাপিয়েই দিলীপবাবুকে ইস্কো হাসপাতালে পাঠাই।” চিকিৎসকেরা জানান, অস্ত্রোপচারের তোড়জোড় চলাকালীনই মৃত্যু হয় প্রাক্তন বিধায়কের। খবর জানাজানি হতেই হাসপাতালে জড়ো হন হাজারখানেক মানুষ। পৌঁছন আসানসোলের সিপিএম সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরী ও দলের জেলা সম্পাদক অমলবাবু। পুলিশ গেলে বিক্ষোভ শুরু হয়। সকাল ১০টা নাগাদ কয়েক হাজার মানুষ মিছিল করে হিরাপুর থানায় গিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এক প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনার বিবরণ জানিয়ে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন।
বছরখানেক আগে বার্নপুরে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে একই ভাবে খুন হন হিরাপুরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক বামাপদ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে অর্পণ মুখোপাধ্যায়। সেই ঘটনার এখনও কোনও কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। তারও বছরখানেক আগে রাতে বাড়ি ফেরার পথে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন সিটু নেতা নির্গুণ দুবে। পুলিশ কমিশনারেট এলাকায় পরপর এমন ঘটনা নিয়ে সরব হয়েছে সিপিএম। দলের রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুর বক্তব্য, “তিন বছরে তিনটে এই রকম খুন হল। কী হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার অবস্থা? কমিশনারেট করে কী লাভ হয়েছে? প্রশাসনিক নজরদারি তো আরও শিথিল হয়েছে!”
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের দাবি, “স্থানীয় সূত্রে জেনেছি, চার বছর আগে এই ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে নারী পাচারের ঘটনায় অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। তবুও চাই, ঘটনার তদন্ত হোক।” যদিও এডিসিপি (পশ্চিম) সুব্রতবাবু জানান, দিলীপবাবুর বিরুদ্ধে এমন কোনও অভিযোগ নেই। সিপিএম সাংসদ বংশগোপালবাবু বলেন, “এমন মন্তব্য করার জন্য আমরা মুকুলবাবুর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব।” আদতে কলকাতার বউবাজারের বাসিন্দা দিলীপবাবু ১৯৬৫ সালে বার্ন স্ট্যান্ডার্ড সংস্থায় চাকরি করতে বার্নপুরে আসেন। সেখানে সিটু-তে যোগ দিয়ে জড়িয়ে পড়েন শ্রমিক আন্দোলনে। শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে বরখাস্তও হন তিনি। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সিপিএমের সর্বক্ষণের কর্মী হন। আশির দশকে দলের বার্নপুর-কুলটি জোনাল সম্পাদক ও জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হয়েছিলেন। ২০০৬ সালে বারাবনি কেন্দ্রে তৃণমূলের মানিক উপাধ্যায়কে হারিয়ে বিধায়ক হন তিনি।
সিটুর সর্বভারতীয় কাউন্সিল সদস্য ও সিটুর খনি শ্রমিক সংগঠন সিএমএসআই-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও ছিলেন। ২০১১ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে দিলীপবাবু আর প্রার্থী হতে চাননি বলে সিপিএম সূত্রে জানা যায়। তবে দল ও শ্রমিক সংগঠনের নানা কর্মসূচিতে যোগ দিতেন নিয়মিত।
কলেজ জীবনে বক্সিং করতেন দিলীপবাবু। সেই ডাকাবুকো মেজাজটা ছিল। তাঁর স্ত্রী শেফালিদেবী জানান, প্রাক্তন বিধায়ক হিসেবে নিরাপত্তারক্ষী দেওয়া হয়েছিল দিলীপবাবুকে।
কিন্তু কয়েক মাস আগে দিলীপবাবুই সেই রক্ষীকে বিদায় করে দিয়েছিলেন। শেফালিদেবী বলেন, “কোনও কথা শুনত না। ইদানীং চারদিকে যা হানাহানির খবর শুনি, তাতে ভয় হত। ভোরে বেরোতে বারণ করেছি। তা কানে তোলেনি। আজও বারণ করেছিলাম।” |