বাবা জ্ঞান দিয়ো না

• বান্ধবীর ইনবক্সে সর্বক্ষণ নজর রাখেন?
• বর দেরিতে বাড়ি ফিরলেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকেন?
• মেয়ে ছুটির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে বেরোলেই অভিমান হয়?
• দাদা-বৌদি আলাদা সিনেমায় গেলেই মনে হয় বোনকে ভুলে গেল ওরা?
• প্রিয় বন্ধুকে ফোন করে কল-ওয়েটিং পেলেই মন খারাপ হয়ে যায়?


এর কোনওটাই কিন্তু ভালবাসা প্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং সমস্যা। নিজের মধ্যে এমন কোনও প্রবণতা খেয়াল করলেই সাবধান হোন। কাউকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত হলে অনেক সময় এমন হয়। কিন্তু অন্যের দিকটা ভাবলেই বুঝতে পারা যাবে ভুলটা। সামলে নেওয়ার চেষ্টা করুন নিজেকে।
যে কোনও ধরনের সম্পর্ক গভীর হলে তার মধ্যে কিছুটা অধিকারবোধ আসার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু তা অতিমাত্রায় গেলে যে নষ্ট হয়ে যেতে পারে সম্পর্কটাই, তার খেয়ালও তো রাখতে হবে। এমনটা মনে করেন মনোবিদেরাও। অপরের প্রতি অধিকার জাহির করতে গিয়েই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেঁধে যায় জট। কখন যে সেই অধিকারবোধ অসহনীয় হয়ে ওঠে প্রিয়জনের কাছে, তার দিকে নজর দেওয়াই হয়ে ওঠে না। চিড় ধরতে শুরু করে অনেক দিনের বন্ধুত্ব, দাম্পত্য বা ভাই-বোন, মা-মেয়ের সম্পর্কে।

স্মৃতি আর অর্কর সম্পর্ক
অর্কর থেকে বয়সে আট বছরের ছোট তাঁর বোন, স্মৃতি। দাদা ওকে বাদ দিয়ে সিনেমায় যাবে ভাবতেই শেখেনি স্মৃতি। ওকে ছাড়া আনন্দ করতে পারে নাকি দাদা? তাই বিয়ের পরে দাদা-বৌদি কোনও দিন ডিনার বা সিনেমায় গেলেই মুখ ভার হয়ে যেত বোনের। সমস্যাটা বুঝতে পেরে স্মৃতিকে বোঝানোর চেষ্টা করেন বাড়ির বড়রা। এ দিকে, বোন দুঃখ পায় দেখে তাকে লুকিয়ে বেড়াতে যেতে শুরু করল দাদা-বৌদি। দূরত্ব বাড়ল দাদা আর বোনের। আজ স্মৃতি বলে, “আগে মানতেই পারতাম না দাদা-বৌদির আলাদা বেরোনোটা। ওদের থেকে কিছুটা দূরেই চলে গেলাম তাই। কলেজে উঠে যখন প্রথম বয়ফ্রেন্ড হল, তখন বুঝলাম মাঝে মাঝে আলাদা বেড়াতে যাওয়াটা কত প্রয়োজন।”
ভালবাসার মানুষের প্রতি অধিকারবোধ তৈরি হওয়া কোনও অপরাধ নয়, এতে লজ্জারও কিছু নেই। শুধু খেয়াল রাখা প্রয়োজন অন্যের পছন্দ-অপছন্দের দিকটা। যতটা অধিকারবোধ প্রকাশ করছেন, তা সহনীয় তো আপনার প্রিয়জনের কাছে? বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলেই কাটিয়ে ফেলা যায় অনেক জট।

মায়ের অতিরিক্ত ‘ইচ্ছে’র শিকার ছেলে
রিয়ার সংসার
এত কিছু না ভাবতে পেরেই সমস্যায় পড়েছিলেন রিয়া। বিয়ে হয়ে বর্ধমান থেকে কলকাতায় আসার পর আর কোনও বন্ধুর সঙ্গেই প্রায় যোগাযোগ ছিল না ওঁর। গোটা দিনটা কাটত স্বামী বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করে। কোনও দিন বরের বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলেই ফেটে পড়তেন অভিমানে। আর বর যদি যায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে, তবে তো কথাই নেই। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত যখন-তখন। রিয়ার প্রাক্তন স্বামী রজত জানালেন, এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই ঝগড়া হতে শুরু করে তাঁদের। রিয়া বুঝত না বন্ধুবান্ধব, অফিসের সহকর্মীর সঙ্গে সময় কাটানো অনেক সময় দরকারি। অতঃপর বহু দিনের টানাপোড়েন শেষ হল বিবাহবিচ্ছেদে। এখন রিয়া একটা কল সেন্টারে কাজ করেন। নিজের জগৎ হয়েছে। এখন বোঝেন, “তখন অত পোজেসিভ না হয়ে বন্ধুর মতো মিশলে হয়তো রজতের সঙ্গে বিয়েটা টিকে যেত।” বুঝতে পেরেছেন বলেই রিয়া-রজত এখনও বন্ধু। মাঝেমধ্যে পুরনো ‘বোকামি’ নিয়ে হাসাহাসিও হয় ওঁদের মধ্যে।
কারও প্রতি পোজেসিভ হয়ে ওঠা মানেই সম্পর্কটার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন আপনি। এমনই মনে করেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল। না হলে কাউকে সব সময় ধরে রাখার ইচ্ছে হত না। অন্য মানুষটাকে সম্পর্কের মধ্যে একটা খোলামেলা পরিবেশ না দিতে পারলে, তার তো দমবন্ধ লাগতে পারে। আর তার থেকেই তৈরি হয় আরও সমস্যা।

ঋক-বৃষ্টির বন্ধুত্ব
বৃষ্টিকে প্রায় চোখে হারাত স্কুলের বন্ধু ঋক। ঋক দুঃখ পেত বলে কলেজে উঠেও নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারত না বৃষ্টি। কিন্তু ঋকের কথামতো চলতে চলতে এক এক সময় বিরক্ত লাগত ওর। স্কুলের বন্ধুদের দলটা ছাড়া আর কোথাও একসঙ্গে আড্ডা দিতে পারত না ওরা। কারণ বৃষ্টি যাদের পছন্দ করে, তাদের কাউকেই ভাল লাগে না ঋকের। বাড়তে থাকে দূরত্ব। বৃষ্টি জানাল, শেষে বাধ্য হয়েই ঋকের সঙ্গে যোগাযোগ কমাতে থাকে সে। বলল, “ঋকের সঙ্গে বন্ধুত্ব না রাখতে পেরে খুবই মন খারাপ হয়। কিন্তু নিজের মতো করে চলতে না পেরে আরও খারাপ লাগত।” তাই ভেঙে গেল ছোট্টবেলার প্রেমটা। বন্ধুদের কাছে এখন ঋক বলে, “হয়তো অতটা ডিমান্ডিং না হলেই পারতাম। বেস্ট ফ্রেন্ডকে হারাতে হত না তবে।”
সময়ের সঙ্গে বদলেছে অবশ্য সম্পর্কে অধিকারবোধের ধারণাও।
দিন দিন ছোট হতে থাকা পরিবারের মধ্যে একে-অপরের প্রতি পোজেসিভনেস বেড়ে গিয়েছে অনেক। কারণ পারিবারিক সম্পর্কগুলো সংখ্যায় কমে যাওয়ায় বাড়তে শুরু করেছে একাকীত্ব।
সব চেয়ে বেশি বেড়েছে অভিভাবকদের সন্তানকে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা। এমনই মনে করেন সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র। তাঁর মতে, সন্তানদের কিছু বিষয়ে ‘ছাড়’ দেওয়াও আসলে অধিকার ফলানোরই একটা পথ। আগে মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের বাইরে সময় কাটানো নিয়ে অনেক সমস্যা হত। এখন সন্তানের চোখে ভাল হতে গিয়ে, তাদের ধরে রাখার চেষ্টায় বাবা-মায়েরা বহু ক্ষেত্রে আধুনিক হতে শিখে নিচ্ছেন। কিন্তু একমাত্র সন্তানের ভাল চাওয়ার নামে তার কেরিয়ার থেকে বিয়ে, সবেতেই নিজের পছন্দ-অপছন্দ চাপিয়ে দিতে চান তাঁরা। আর তাতেই চিড় ধরার আশঙ্কা থাকে সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কে।

নীল-শিল্পীর কথা
পেশায় স্কুল-শিক্ষক বাবা অধীর মিত্র চাইতেন নীল আর শিল্পী, তাঁর দুই ছেলেমেয়ে অনেক দূর পর্যন্ত লেখাপড়া করুক। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছে হল স্কুল পাশ করেই পাইলটের ট্রেনিং নেওয়ার। শুরু হল বাবার সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক। একটু বড় হতেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দু’জনেই। এখন পেশায় বিমানসেবিকা শিল্পীর বক্তব্য, “বাবা-মায়ের সমর্থন পেলে পাইলট হতে পারতাম হয়তো। কেরিয়ারটা ওঁদের জন্যই নষ্ট হয়ে গেল।” তবু অধীরবাবুর বক্তব্য, “ছেলেমেয়ের ভাল চাওয়াও কি অন্যায়?” ভুল কোথায় হল, বুঝতে পারেননি মিত্র দম্পতি।
তবে ভাল চাওয়া মানে যে সন্তানের ভাল লাগার উপরে জোর খাটানো নয়, তা মেনে নিয়েছেন বাগবাজারের রাত্রির মা। মেয়ে যখন কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে গান নিয়ে পড়াশোনা করবে ঠিক করল, চিন্তা হয়েছিল তাঁরও। কিন্তু তা চেপে রেখে নিজেই রাত্রিকে বলেছিলেন, তার যা যা প্রয়োজন সেগুলো যেন জানায়। “মেয়ের উপরে জোর করে তো ওকে ভাল রাখা যাবে না। ও কীসে ভাল থাকবে, সে দিকে খেয়াল তো আমাকেই রাখতে হবে,” বললেন তিনি। কাউকে ভালবাসা মানে তাঁর পছন্দ-অপছন্দ নিয়ন্ত্রণ করা নয়। জোর খাটালে কোনও সম্পর্কই বেশি দিন সুস্থ থাকতে পারে না। এ কথাই বারবার মনে রাখতে বলছেন নীলাঞ্জনাদেবী।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.