|
|
|
|
বাবা জ্ঞান দিয়ো না |
মাউসে সা রে গা মা
গান ভালবাসেন, অথচ গুরুর কাছে পৌঁছতে পারছেন না? হয়তো আপনি খুব ব্যস্ত। কিংবা দেশান্তরী।
অনলাইন গানের ক্লাস হতে পারে তার লা-জবাব সমাধান। সন্ধান দিচ্ছেন রেশমি বাগচি |
কাকলির দারুণ মিষ্টি গলা। বিয়ের আগে কত গান গেয়েছে পাড়ার ফাংশনে। কিন্তু সেই ভাবে শেখা হয়নি কখনও। এখন ওর কাছে বিস্তর সময়। বিদেশে এসে বড় একা হয়ে গিয়েছে। ওর খুব ইচ্ছা এত দিন সময়ের অভাবে যা হয়নি, এখন তা পূরণ করার। কিন্তু বিদেশে কে শেখাবে ওকে গান? খোঁজখবর করতে গিয়ে কাকলি খবর পেল অনলাইন গান শেখার ক্লাসের। ক্লাসে গিয়ে দেখল, ছাত্র-ছাত্রীরা ঘিরে রয়েছেন গুরুকে। তানপুরা বাজছে, তবলা বাজছে, সুরের ওঠা-নামায় এক অপূর্ব নৈসর্গিক পরিবেশ। গুরু চোখ বন্ধ করে বিলম্বিত খেয়াল গাইছেন। শিক্ষার্থীরাও রেকর্ডারে চটপট বিষয়টি ধরে রাখছেন। না, আর পাঁচটা গানের ক্লাসের সঙ্গে সেই অর্থে কোনও পার্থক্য নেই। তফাত একটা জায়গাতেই। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ যার মাধ্যমে হচ্ছে, তা হল পি সি বা ল্যাপটপ। একেই বলে অনলাইন গান শেখা। এ পারে গুরু, ও পারে শিক্ষার্থী। গুরুর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের এর চেয়ে ভাল মাধ্যম আর কী-ই বা হতে পারে। পৃথিবীর যে কোনও জায়গা থেকেই পছন্দের গান বা ইন্সট্রুমেন্ট শিখুন নির্ঝঞ্ঝাটে।
অনলাইনের সুবিধা
প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে, আজ সত্যি অনেকের স্বপ্নই সফল হতে পারছে। আপনি আপনার ইচ্ছেমতো মাসে ২-টি বা ৩-টি ক্লাস করতে পারেন। সময় এক থেকে দু’ঘণ্টা। আপনার বাড়িতে কম্পিউটার থাকতে হবে, স্পিকার লাগবে। ওয়েব ক্যামেরা থাকলে ভাল। আপনি গুরুকে নিজের চোখে দেখতে পাবেন। স্কাইপে ক্লাস হবে। সঙ্গে রাখবেন একটা রেকর্ডার। যা শিখলেন তা পরে বারবার শুনতে পারবেন তা হলে। কোনও স্বরলিপি বা রাগ সম্পর্কে জানতে চাইলে গুরুর সঙ্গে মেল-এ যোগাযোগ করতে পারবেন। সেতারবাদক পূর্বায়ন চট্টোপাধ্যায়ের অনেক ছাত্র অনলাইনে তাঁর কাছে শেখেন। এখন অনেক রকম উন্নত প্রযুক্তি সংবলিত অ্যাপস্ আছে, যার মাধ্যমে ভিডিয়ো কনফারেন্সিং-এর সাহায্যে পৌঁছে যাওয়া যায় ছাত্রছাত্রীর কাছে। শুধু বিদেশেই নয়, দেশের মধ্যেও অনেকে আছেন যাঁরা ইচ্ছে করলেও শিখতে আসতে পারেন না। অনলাইন নিঃসন্দেহে তাদের কাছে সুবর্ণ সুযোগ। কৌশিকী চক্রবর্তী মনে করেন, আগে যা অসম্ভব ছিল, তাই আজ সম্ভব হয়েছে। সুদূর আমেরিকাতে বসেও মানুষ ভারতীয় সঙ্গীত শিখতে পারছেন। যাঁরা অনলাইনে শেখেন বা শেখান, তাঁরাও জানেন সামনে বসে শেখার মতো আদৌ নয় বিষয়টি। তবে এটা মানতেই হবে কিছুটা অন্তত অ্যাকসেস পাচ্ছেন তো শিক্ষার্থীরা। মল্লার ঘোষের যে সব ছাত্র বিদেশ থেকে আসেন, তাঁরা যখন খেই হারিয়ে ফেলেন, তখন অনলাইনে এক বার ঝালিয়ে নেন। এ হল যে কোনও মুহূর্তে, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্ত থেকে গুরুকে হাতের কাছে পাওয়া।
অনলাইন বা ইন্টারনেটে গিটার বাজানো শিখেছেন রূপম। “ভোকালের ক্ষেত্রে অনলাইন খুব ভাল অপশন মনে করি না ঠিকই, কিন্তু ওই কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো পিয়ানো বা গিটার শিখেছি বিভিন্ন ভিডিয়ো দেখেই। সম্প্রতি একটি চার-তারের গিটারের মতো ইন্সট্রুমেন্ট, যাকে ইউকুলেনে বলে, সেটা সম্পর্কে জানা ও শেখা সবটাই ইন্টারনেটের মাধ্যমেই হল,” বক্তব্য তাঁর।
|
|
গুরুর সঙ্গে অটুট বন্ধন
গান শেখা মানে শুধুই গানটুকু তুলে নেওয়া নয়। গান শিখতে শিখতে গুরুর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়, আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। একজন শিল্পীর জীবনে, ওটাই সব চেয়ে সুখের সময়, মনে করেন শহরের গাইয়েরা। অনলাইনে গান শেখার ক্ষেত্রে, যা ততটা পাওয়া সম্ভব নয়। কৌশিকী মনে করেন, বছরের পর বছর গুরুর সঙ্গে থাকা, সবাই একসঙ্গে রেওয়াজ করা এই সবই শেখার অঙ্গ। গুরুর সঙ্গে যদি আমার সারাক্ষণ যোগাযোগ না থাকে, তা হলে তো শেখাটাই সম্পূর্ণ হবে না। গুরু কী ভাবে শেখান, কী ভাবে কথা বলেন, কী ভাবে তান ধরেন, স্টেজে কেমন ভাবে বসেন, ওঁর চিন্তা-ভাবনা, পছন্দ-অপছন্দ, এগুলো সব জানতে হবে, বুঝতে হবে। অনলাইন গান শেখার ক্ষেত্রে সেটা কতটা পাওয়া সম্ভব জানি না। কৌশিকীর মতে, অনেকটা ভক্তের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্কের মতোই হয় গুরুশিষ্যের সম্পর্ক। শিল্পী মল্লার ঘোষও তাই মনে করেন। জানালেন সরাসরি গুরুর সামনে বসে তালিম নেওয়ার চেয়ে ভাল আর কী-ই বা হতে পারে। আমার গুরু, আমার বাবা পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে কখনও হয়তো তালিম নেওয়া শুরু করতেন ভোর পাঁচটায়। শেষ হত দুপুরে। বা রাত দু’টোয় শুরু হয়ে শেষ হত সকালে। গুরুর পায়ের কাছে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শেখা, ওই ‘অরা’র সাক্ষী হওয়াটাই একটা দারুণ অভিজ্ঞতা।”
পারস্পরিক আদানপ্রদান
“অনলাইনে যদি সময়ের কোনও বাঁধন না থাকে, দীর্ঘক্ষণ আলোচনা, কথাবার্তা বলা যায়, তা হলে ভাল। কারণ গান শেখানোর ক্ষেত্রে সব চেয়ে জরুরি বিষয় হল শিক্ষার্থীর গুরুকে চেনা। আবার ঠিক উল্টো অর্থে গুরুর শিক্ষার্থীকে চেনা। গানের ক্লাস যেন আনন্দের হয়,” বললেন শ্রাবণী সেন। তিনি নিজে গান শেখার সময় গান ফেলে তবলা বাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। আরও জানালেন “আমি তো ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে দিব্যি আড্ডা জুড়ে দিই। ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কত কিছু শিখি, জানি। ওরা কখনও হয়তো আমাকে বলল, এই জায়গাটা এ রকম ভাবে গাইলে দম নিতে সুবিধা হবে। আমি করে দেখি সত্যিই তো! এই ভাবেই তো আদানপ্রদান হবে। আবার এই সে দিন আমার এক ছাত্রীর জন্মদিনে ক্লাসে সবাই মিলে কেক কাটা হল, খাওয়াদাওয়া হল। এই সব ছাড়া শেখাটা বড় নীরস হয়ে যাবে।”
গানের মাঝে বাজে বকারও প্রয়োজনীয়তা আছে, মনে করেন রূপম। না হলে ব্যাপারটা কেমন রোবোটিক হয়ে যাবে। বললেন “আমি নিজে যখন গান শেখাতাম, সময়ের কোনও লিমিট থাকত না। দুপুরে শুরু হলে শেষ হতে হতে সেই সন্ধে গড়িয়ে যেত। প্রকৃত ভাবে শেখাতে গেলে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা সময় দিতে হয়। কার কোন সুর লাগছে না লাগছে সেটা বুঝতে হয়।” রূপম নিজের গুরুর কথা বলতে গিয়ে জানালেন, কী ভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা গান ছেড়ে গল্প করতেন, নিজের লেখা ও সুর করা গান তাঁকে শোনাতেন। গুরু মন দিয়ে শুনে ফিড-ব্যাক দিতেন। কোন জায়গাটা অন্য রকম ভাবে করলে আরও ভাল হবে, তা বলেও দিতেন। “গুরুর সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে কখন যে কী শেখা হয়ে যাবে, তার কোনও ঠিক নেই,” বললেন পূর্বায়ন। “একবার টানা ৬ মাস সান ফ্রান্সিসকোয় আছি, গুরুও আছেন। ডালে তড়কা দিতে দিতে বললেন, একটি রাগের কথা। ডালের তড়কার মতোই ওই রাগের তড়কা, অর্থাৎ মূল মজাটা কোথায়, নিমেষে বুঝিয়ে দিলেন।” |
|
অনলাইনের অসুবিধা
সবই ঠিক আছে, কিন্তু শেখার ক্ষেত্রে অনলাইন যে খুব কার্যকর তেমনটা কেউই বলছেন না। “এমনটা ভাবা ঠিক হবে না, যে অনলাইনে শিখে কেউ খুব বড় গাইয়ে হবে। বেসিক কিছু হয়তো শিখতে পারে,” বললেন কৌশিকী। শ্রাবণী সেনের মতে, “এক্ষেত্রে গুরু ও শিক্ষার্থীকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমি যখন শেখাই, সুর এ দিক ও দিক হলে, ঠিক কানে বাজে। কিন্তু স্কাইপে যদি গুরু ধরতে না পারেন! কারণ অনেক সময় কানেকশনেও গণ্ডগোল হয়। তখন শেখাটা পুরো ভুল হয়ে যাবে। যারা অনেক দিন গানবাজনা করছেন, তারা হয়তো অনলাইনেও গান শিখে নিতে পারবেন। নতুনদের পক্ষে ব্যাপারটা বেশ অসুবিধার হতে পারে,” মনে করেন তিনি। পূর্বায়ন নিজে শেখাতে গিয়ে বুঝেছেন, তাল সঠিক হওয়া খুব মুশকিল। আমি যে সময় হাতে তালি দিচ্ছি, একটু পরে তা আমার ছাত্ররা শুনতে পাচ্ছে। একটু ডিলে হবেই। উনি মনে করেন, ঠিক যে কারণে আমরা ডিসট্যান্স কোর্স না করে, স্কুল, কলেজে গিয়ে পড়াশুনা করেছি, সেই কারণেই গুরুর সান্নিধ্য দরকার। ‘‘যতই উন্নত প্রযুক্তি হোক না কেন, আন্তরিকতার অভাব বোধ হয়। গুরুর শেখানোর পদ্ধতি, আর অনলাইন দু’টোই তো প্রত্যক্ষ করলাম। বলুন তো, শ্রদ্ধার সম্পর্ক কি আর ক্যামেরার মাধ্যমে গড়ে ওঠে?” বললেন মল্লার ঘোষ।
ভাল করে শিখতে হলে চলে এসো
নিজের জগৎ ছেড়ে, মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে, গানের টানে চলে এসেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাশা। অনলাইনের সুবিধা নিলেন না কেন? “আমার ছোটবেলায় এই প্রযুক্তি শুরুই হয়নি। কলেজ জীবনে জানতে পারলাম, এই অনলাইন গান শেখার বিষয়টি। কিন্তু সামনাসামনি দেখা না হলে কি গান শেখা হয়? কত প্রশ্ন করতাম শেখার মাঝে, অনলাইনেও হয়তো সেটা হবে। কিন্তু ওই স্বাচ্ছন্দ্যটা থাকবে না। যন্ত্র আমাদের অনেক সুবিধা করেছে ঠিক, কিন্তু গুরুর স্নেহ, ভালবাসা, সেই পারসোনাল টাচ, কি পৌঁছে দিতে পারবে? তাঁর মতে, ‘‘একটু-আধটু শেখার জন্য ঠিক আছে। যদি কেউ ঠিকমতো শিখে পারফর্ম করতে চায়, তা হলে তাকে গুরুর কাছে যেতেই হবে।” মল্লার ঘোষ তাঁর জাপান, আমেরিকার ছাত্রদের বলেন, বছরে এক বার এসে, ১০ দিন থেকে শিখে যেতে। কারণ অনলাইনে ৬ মাস ধরে যা শিখবে, তার চেয়ে ঢের বেশি এই ১০ দিনে শিখতে পারবে তারা।
অনলাইন সঙ্গীত শিক্ষার আর একটা বাড়তি পাওনাও আছে। গুরুর কাছ থেকে হয়তো মাঝেমধ্যেই তাঁর বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ পাবেন। সুযোগ কাজে লাগিয়ে কয়েক দিন ছুটি নিয়ে সটান চলে আসুন। গান শেখাও হল, নতুন একটা জায়গা ঘোরাও হল। ফিরে গিয়ে তাড়াতাড়ি একটা গেট টুগেদার-এর আয়োজন করুন। ভাল গানের গলা বলে এমনিই আপনার সুনাম আছে, গুরুর কাছে সদ্য শেখা নতুন কিছু গান শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিন সবাইকে। |
|
|
|
|
|