হু ল্লো ড়
সামনে যখন সেলিব্রিটি
সামনে বিশ্বখ্যাত ছ’ফুট এক ইঞ্চি। বয়সে আমার ঠিক দ্বিগুণ। সাক্ষাৎকারের মেজাজটা সবে জমে উঠেছে। ইতিমধ্যেই দু’একটা ভুলে যাওয়া সাল মুখে মুখে ধরিয়ে দিয়েছি বলে ভারতের স্মার্টেস্ট দীর্ঘদেহী যাকে বলে ‘ইমপ্রেস্ড’। বলেছেন ‘আপ কা হোমওয়ার্ক তো বহৎ-ই জবরদস্ত হ্যে’। প্রশ্নটা করলে বিরক্ত হয়ে শক্ত চোয়ালে লেপল্ খুলে উঠে যেতেও পারেন। তবু টাইমিং বুঝে করলাম ডেলিভারি “সত্তরের দোরগোড়ায় পৌঁছে, এই বয়সে কাকে বেশি ভাল লাগে জয়া না রেখাকে?”
স্থির চোখে তাকালেন অমিতাভ বচ্চন। বেশ কয়েক সেকেন্ডের হিরণ্ময় নীরবতা। প্রতিক্রিয়ার প্রত্যাশায় গোটা ঘরের সবার হৃদস্পন্দন দ্রুততর। তার পর মুচকি হেসে দীর্ঘ এক বিশ্লেষণ। আমি নিশ্চিন্ত, সাক্ষাৎকারটা উতরে গিয়েছে!
পেশাদারি জীবনে প্রতিটা সাক্ষাৎকারই একটা ব্লাইন্ড ডেট। অচেনা ব্যক্তিত্ব হলে তো কথাই নেই। চেনা লোকেরও অচেনা দিকটুকু খুঁজে না আনতে পারলে ইন্টারভিউটা মাঠে মারা যায়। মনে আছে, কী অবর্ণনীয় আনন্দ পেয়েছিলাম পণ্ডিত রবিশঙ্করের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ে। এক দিকে বৈদগ্ধ এবং প্রজ্ঞা অন্য দিকে নতুনকে গ্রহণ করার উদারতা এবং শিশুর মতো কৌতূহল। মনে হচ্ছিল এই আলাপচারিতা চলতেই থাকুক। সুরস্রষ্টা রবিশঙ্করকে তো সবাই চেনে, কিন্তু পিতা রবিশঙ্কর? অনুষ্কা না নোরা বাবার অপত্য স্নেহের পাল্লা কার দিকে ভারী? এ প্রশ্ন করেও দুই কন্যার চরিত্রের কী চমৎকার একটা ব্যাখ্যা পেয়েছিলাম অন ক্যামেরা!
কন্যা অনুষ্কার সঙ্গে রবিশঙ্কর
‘ইন্টার’ আর ‘ভিউ’ দু’টি শব্দই মূলগত ভাবে ফরাসি। ফরাসিতে ‘ইন্টার’ যখন পদান্বয়ী অব্যয়, তখন তার অর্থ পারস্পরিক। আর ‘ভিউ’ তো ‘দর্শন’। তো ক্যামেরায় এই ‘পারস্পরিক দর্শন’-এর জন্য কত দিনের ‘লেগে থাকা’র একঘেয়ে পরিশ্রম প্রয়োজন হতে পারে? কখনও কখনও বছরের পর বছর। সৌভাগ্য, প্রতিবেশী পাকিস্তানে একটি লোমহর্ষক সাক্ষাৎকারের জন্য আমায় লেগে থাকতে হয়েছিল চোদ্দো দিন।
‘ভাই পহেলওয়ান’। নিন্দুকরা বলে, লাহৌরের সব চেয়ে বড় মাফিয়া ডন। যাঁর দাপটে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর রাজনীতিবিদরাও এক ঘাটে জল খায়। যিনি বাড়িতে প্রায় কুকুর-বিড়ালের মতো সিংহ আর চিতা পোষেন। এবং তাঁরই বাড়ির পোষ্য ধার করে মিছিল সাজান এমনকী ‘পাকিস্তানের সিংহ’ বলে খ্যাত নওয়াজ শরিফ-ও! এহেন পালোয়ানের সাক্ষাৎকার পাওয়ার জন্য চোদ্দো দিনও বেশি মনে হয়নি।
ভাই-এর পরিবারের বেশির ভাগ আত্মীয়স্বজন, এমনকী তাঁর তিন পুত্রও আন্ডারওয়ার্ল্ডের ‘মুঠভেড়’-এ মারা গিয়েছেন। তাই ২৪ ঘণ্টা তাঁকে ঘিরে রাখে সাতটি স্তরের নিরাপত্তা অসংখ্য নিরাপত্তারক্ষীর প্রত্যেকের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র একে ৪৭, নয় ৫৬। চোদ্দো দিন ধরে জপিয়ে তাঁকে যখন ক্যামেরার সামনে আসতে রাজি করলাম, অদ্ভুত একটা শর্ত দিলেন ‘ভাই পহেলওয়ান’।
এভারগ্রিন দেব আনন্দ
তাঁর প্রাইভেট গ্যালারিতে বসে তাঁর সঙ্গে কুকুরের লড়াই দেখলে তিনি মুখ খুলবেন পরদেশি সাংবাদিকের কাছে। বীভৎস সে বিড়ম্বনা দু’টি ট্রেনিংপ্রাপ্ত তিন দিনের অভুক্ত সারমেয় আমৃত্যু লড়ে গেল যত ক্ষণ না একটি রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হয়ে ঢলে পড়ল। একবিংশ শতাব্দীতে বসে এমন মধ্যযুগীয় দৃশ্য হয়তো আমারই অবিশ্বাস্য মনে হত যদি না সবটুকু আজও মুভি ক্যামেরায় ধরা থাকত। অবশেষে আমার প্রায় আধ-মাসের পরিশ্রম সার্থক করে পোষা সিংহের কেশরে হাত বুলোতে-বুলোতে টিভিতে জীবনে প্রথম বার মুখ খুললেন লাহৌরের অঘোষিত শাহেনশা!
সব রক্ত কি চোখে দেখা যায়? সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তেমন রক্তপাতের সাক্ষীও হতে হয় বহু বার। ‘এভারগ্রিন’ দেব আনন্দের জীবনে চর্চিত ও চর্চার বাইরে নারী এসেছিল অসংখ্য। তবু দীর্ঘ ক্ষণ সুরাইয়ার কথা বলতে বলতে এত বছর পরেও যখন চিরযুবাকে হাতের তালুতে চোখ থেকে মুক্তো ঝরাতে হয়, সামনে বসা প্রশ্নকর্তা বোঝে সে প্রেম কত গভীর। “আমাকে ভারতের গ্রেগরি পেক বললে সুরাইয়া খুব খুশি হত, আমার কোনও কালেই এটা ভাল লাগত না... ওকে বড্ড ভালবাসতাম” বলে থেমেছিলেন দেব আনন্দ, মনে হয়েছিল আর্দ্রতার আতিশয্যে, স্মৃতির ভারে।
বিশ্বখ্যাত সেই ছ’ফুট এক ইঞ্চি মান্না দে
সাক্ষাৎকারের ঝাঁপি খুলে স্মৃতি ঘাঁটতে বসলে খুব মনে পড়ে আজ থেকে সাত বছর আগে বেঙ্গালুরুর এক দুপুর। মান্না দে-র জন্মদিনে তাঁর বাড়িতে আচমকা এবং একমাত্র অতিথি আমি। প্রবাদপ্রতিম গায়কের স্ত্রী সুলোচনা তখনও বেঁচে। দুপুরে কিমা-খিচুড়ি, পকোড়া আর পাঁপড়ভাজা খেয়ে ক্যামেরা অন করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যেটা চলল সেটা কতটা টিভি সাক্ষাৎকার আর কতটা আন্তরিক আড্ডা, মান্না দে-র এই অসমবয়সী গুণগ্রাহী আজও বুঝে উঠতে পারেনি।
যেমন বুঝিনি আমাকে দেওয়া জ্যোতি বসুর সাক্ষাৎকারের সময়ে তাঁর প্রশ্রয়ের কারণ। জ্যোতিবাবুর বয়েস তখন প্রায় ৮৪, আর আমার ২৩। অফলাইন সাক্ষাৎকারটির শেষে আমার ‘ধন্যবাদ’ দেওয়ার পর বসুর ‘নমস্কার’ বলাটা কিছুতেই ‘সিনক্রোনাইজ’ হচ্ছে না। হয় ঠিক সময়ে হাত তুলতে ভুলে যাচ্ছেন, নয়তো অন্য দিকে তাকিয়ে ফেলছেন। শেষ পর্যন্ত পাঁচবারের চেষ্টায় ‘শট ওকে’। আশ্চর্য, একটুও বিরক্ত না হয়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হেসে বলেছিলেন, “উফ্, টিভিতে এত নাটক করতে হয়!”
অবশ্যকর্তব্য
• পুরনো ব্রিটিশ ঘরানার সাংবাদিকরা বলতেন, ‘দ্য বেস্ট ইন্টারভিউয়ার ইজ হি হু ক্যান লিসন’। মনে রাখতে হবে, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর কথা শোনার চেয়ে দর্শক নিশ্চয়ই যিনি সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তাঁর কথা শুনতে বেশি আগ্রহী (আর তা না হলে প্লিজ সময় নষ্ট করবেন না)। রাজনীতিবিদরা অবশ্য মিথ্যের আশ্রয় নিলে এবং হাতে তা ‘কাউন্টার’ করার মতো অকাট্য তথ্যপ্রমাণ থাকলে, তাঁকে বক্তব্যের মাঝখানে থামানোই যায়।

• রাজনৈতিক সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তা সাংবাদিককে সব সময় ‘ডেভিল’স অ্যাডভোকেট’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বটির বক্তব্যের পাল্টা যুক্তি ও তাঁর প্রতিপক্ষের অভিযোগগুলি যেন সাক্ষাৎকারের প্রশ্নে অবশ্যই থাকে।

• যথেষ্ট হোমওয়ার্ক ছাড়া সাক্ষাৎকার নেওয়া অপরাধ। ‘সাবজেক্ট’-এর ঘনিষ্ঠ মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাঁর লেখা বা তাঁর উপর লেখা বই পড়তে হবে। প্রয়োজনে ইন্টারনেটের সাহায্য নিতে হবে। হোমওয়ার্কে ফাঁকিবাজি থাকলে প্রশ্নকর্তাও যে কোনও মুহূর্তে ফাঁকে পড়তে পারেন।

• সাক্ষাৎকার যিনি দিচ্ছেন তিনি কখনও মেজাজ হারিয়ে আক্রমণে গেলেও মাথা ঠান্ডা রেখে হাসি-মুখে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে হবে।

• সুযোগ থাকলে নির্ধারিত সময়ের একটু আগে গিয়ে প্রথম বার যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে তাঁর সঙ্গে একটু আলাপ জমিয়ে ‘স্টাডি’ করা উচিত। নিদেনপক্ষে ফোনে একটু ‘গল্প’ করে নিলে সাক্ষাৎকারটি আরও তরতরিয়ে এগোবে সন্দেহ নেই।

প্রাক্তন থেকে এ বার আসি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর কথায়। ২ এপ্রিল ২০০৯। ফায়ারব্যান্ড নেত্রী তাঁর জীবনের প্রথম লাইভ সাক্ষাৎকারের জন্য কোনও টেলিভিশন স্টুডিয়োতে পা রাখলেন। মনে আছে, কয়েক ঘণ্টা আগে নেত্রীর ছায়াসঙ্গী এক বর্ষীয়ান নেতা বাজি ধরেছেন, “টানা দু’ঘণ্টা একটা চেয়ারে বসে থাকবে মমতা? জাস্ট অসম্ভব।” অথচ সে দিন আর তার পরের অন্তত এক ডজন সাক্ষাৎকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জলের গ্লাসে বা চায়ের কাপে একবারও চুমুক না দিয়ে টানা আড়াই ঘণ্টা বিরতিহীন ভাবে প্রশ্নের বাউন্সার সামলেছেন।
‘সামলেছেন’ বলছি বটে, তবে পেশাদার প্রশ্নে মুহূর্তে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিকই আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে যান। স্টুডিয়োতে সে রকম মুহূর্ত বারবার এসেছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম ৭০ দিনেই ৪০টি কমিটি তৈরির যৌক্তিকতা জানতে চাইলেই ফুঁসে উঠেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাল্টা আঘাত হেনে প্রশ্নকর্তাকে বলেছেন, চ্যানেলের কায়েমি স্বার্থেই তাঁকে ডেকে এই প্রশ্ন করা হচ্ছে। কিংবা দীপা দাশমুন্সি, না মানস ভুঁইয়া কে বেশি অপছন্দের, এ প্রশ্নের উত্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে নিঃশব্দ মুখভঙ্গি পেয়েছি তা অন্তত ছাপার অক্ষরে বোঝানোর ভাষাগত ব্যুৎপত্তি এ সাংবাদিকের নেই।
আর সাক্ষাৎকারের আসল চার্ম, আনপ্রেডিক্টেবিলিটিতেই লুকিয়ে আছে মজাটা। আসল মানুষটাকে পাঠক-দর্শকদের সামনে বের করে আনার আনন্দ। কখনও কাঁদিয়ে,
কখনও হাসিয়ে, আবার এমনকী রাগিয়েও!

নৈব নৈব চ
• সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে বিনয়ে গদগদ হয়ে নুয়ে পড়বেন না। পাশাপাশি সবজান্তার মতো ঔদ্ধত্য দেখানোও প্রশ্নকর্তা সাংবাদিককে মানায় না। আগাগোড়া পেশার সম্মান বজায় রাখুন।

• দীর্ঘ ক্লান্তিকর ‘ফুটেজখেকো’ প্রশ্ন নৈব-নৈব চ। প্রশ্ন হবে ধারালো ও সংক্ষিপ্ত।

• প্রয়োজনে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে অবশ্যই পাল্টা-যুক্তি দিতে হবে, কিন্তু তা যেন স্বাভাবিক সম্মান, সৌজন্য ও আন্তরিকতা বিযুক্ত না হয়। হাজার হোক যিনি সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তিনি প্রশ্নকর্তার ‘অতিথি’।

• নিজের স্বাভাবিক বাচনভঙ্গিই নিজের স্টাইল, ট্রেডমার্ক ও ইউএসপি অন্য কারও স্টাইল নকল করতে যাওয়া আত্মহত্যার শামিল।

• রাজনীতিবিদদের সাক্ষাৎকারের আগে, পরে বা বিরতিতে বহু আলোচনা হয়, যা হয়তো ‘অফ দ্য রেকর্ড’। সেগুলোর উল্লেখ, যে কোনও অবস্থাতেই নীতিহীনতা। ক্যামেরার সামনে সাক্ষাৎকারটি এতটাই আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে, যাতে এ ধরনের ‘মশলা’র দরকারই না হয়।

• পোশাকের ক্ষেত্রে যত্নবান হওয়া উচিত। শেরওয়ানি পরে সিঙ্গুরের কৃষকের সাক্ষাৎকার বা অবিন্যস্ত-অপরিষ্কার পোশাকে শাহরুখ খানের সাক্ষাৎকার দু’টোই দর্শকদের সমান বিরক্ত করে।

• টিভি-সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে চড়া মেকআপ এড়িয়ে চলাই ভাল। না হলে দর্শকদের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয় বলে আমার বিশ্বাস।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.