|
|
|
|
অনেক আদর বলে আর কেউ এসএমএস করবে না |
ঋতুপর্ণ ঘোষের স্মৃতি ভিড় করে আছে তাঁর মনে। সেই ভারাক্রান্ত মনেই কান
চলচ্চিত্র উৎসব, নতুন সংসার, বরসব নিয়ে কথা বললেন বিদ্যা বালন।
শুনলেন সংযুক্তা বসু |
• শোনা যায় ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে আপনার কাজ করার কথা হয়েছিল। সেটা আর হল না...
না। হল না। খবরটা পেয়ে আমি এত ভেঙে পড়েছিলাম, এত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারব না।
• ওঁর সঙ্গে তো প্রায়ই কথা হত আপনার?
হ্যা।ঁ হতই তো। প্রত্যেক বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস এলেই ঋতুপর্ণ আমায় ফোন করত। বলত, “এ বছর আমরা একসঙ্গে কাজ করব।” কিন্তু এই বছর কেন যে ফোন করেনি জানি না। মনে পড়ছে ‘অসুখ’ দেখার পর আমি ওর ছবিতে কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। ও বলেছিল কাজ করব একসঙ্গে। কত ছবির গল্প শুনিয়েছে আমায়! কিন্তু শেষমেশ কাজ হয়নি।
• কাজ হল না কেন?
আমাদের দু’জনের ডেটে মিলত না বলে। মনে পড়ছে একটা গল্পের কথা, যেখানে এক জন সিনেমা পরিচালকের গল্প নিয়ে কাজ করছিল ও। আমাকে সেখানে এক জন অল্পবয়সী অভিনেত্রীর চরিত্রে অভিনয় করতে বলেছিল। কিন্তু শু্যটিংয়ের সময়টা মিলল না বলে করতে পারলাম না। কী ছবিটা যেন...
• আপনি বোধহয় ‘আবহমান’ ছবির কথা বলছেন?
হতে পারে ‘আবহমান’।
• ঋতুপর্ণকে নিশ্চয়ই এ বার খুব মিস করবেন?
হ্যা।ঁ মিস তো করছিই। বিশেষ করে কলকাতা গেলে ওর কথা খুব মনে হবে। এক বার কী একটা যেন অনুষ্ঠানে কলকাতা গিয়েছিলাম বছর পাঁচেক আগে। ঋতুপর্ণ আমাকে গাড়ি করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়েছিল। গাড়িতে যেতে যেতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা হয়েছিল অনেক ক্ষণ। ওর কাছ থেকে এসএমএসগুলো আর আসবে না।
• এস এম এসে কথা হত?
হ্যাঁ, অনেক সময়ই কথা হত এসএমএস-এ। সব কথার শেষে ও লিখত ‘অনেক আদর’। এমন ভাবে কেউ আর এস এম এস করবে না। এত আন্তরিকতা আমি খুব কম মানুষের মধ্যেই পেয়েছি। ‘পরিণীতা’ ছবি করার পর প্রথম যে দিন আলাপ হয়েছিল, মনে হয়েছিল যেন কত দিনের আলাপ।
• বাংলা ছবিতে অভিনয় করার কথা ভাবছেন?
সেটা তো ঋতুপর্ণই খুব বেশি করে আমাকে ভাবিয়েছিল। এখন জানি না কী হবে। বাংলা ছবিতে কাজ করার ইচ্ছে খুবই। নিশ্চয়ই কোনও না কোনও দিন ইচ্ছেটা পূরণ হয়ে যাবে।
• এ বার কান ফেস্টিভালের কথায় আসি। আপনি তা হলে প্রমাণ করে দিলেন যে খোলামেলা পোশাক না পরেও কানের মতো চলচ্চিত্রোৎসবে গিয়ে প্রতিনিধিত্ব করা যায়...
আমি তো কোনও কিছু প্রমাণ করতে চাইনি। আমাকে যা মানায়, তাই পরেছি। শাড়ি পরেছি। কলিদার কুর্তা পরেছি। মোট কথা ভারতীয় পোশাকেই নিজেকে মেলে ধরতে চেয়েছি। আমার সাজ-পোশাকে অবশ্যই ডিজাইনার সব্যসাচীর একটা ভূমিকা ছিল। ভারতের হয়ে যখন প্রতিনিধিত্ব করছি, তখন পোশাক পরিচ্ছদে যথেষ্ট ভারতীয় ভাব থাকাটাই তো আমার ফ্যাশন হওয়া উচিত ছিল। সেটাই করেছি স্বাভাবিক ভাবে।
• কান-এ গিয়ে স্পিলবার্গের মতো মানুষজনের সঙ্গে দেখা হল। কী কথা হল?
প্রচুর আড্ডা হয়েছে সব জুরির সঙ্গেই। ওখানে পরিচালক অ্যাং লি-র সঙ্গে দেখা। উনি আলফানসো আম খেতে খুব ভালবাসেন। আমার বর সিদ্ধার্থর কানে যখন এই কথা গেল, তখন চুপড়ি করে প্রচুর আলফানসো নিয়ে গিয়েছিল। সবাই আম খেয়ে কী খুশি!
• প্রসেনজিতের সঙ্গে দেখা হয়েছে তো...
হ্যাঁ দেখা তো হয়েইছে। কিন্তু হাই হ্যালো আর টুকটাক কিছু কথার বেশি আড্ডা গড়াল না। সকলেরই নানা ব্যস্ততা। তবে ওকে বলেছি কলকাতায় গেলে অবশ্যই দেখা করব। বুম্বাদা মুম্বই এলে আমার বাড়িতে আসার কথাও বলেছি।
• এক দিকে কান চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি, অন্য দিকে ইমরান হাসমির সঙ্গে ‘ঘনচক্কর’এর মতো ছবি রিলিজ করা। জীবনটা তো দারুণ ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠেছে। কী বলেন?
হ্যাঁ, ঈশ্বরের অসীম আশীর্বাদ যে এই বছরটা এত গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠেছে। সব চেয়ে বড় কথা রাজকুমার গুপ্তার মতো পরিচালকের সঙ্গে আবার কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ইমরান হাসমির সঙ্গে ‘ডার্টি পিকচার’ করার সময় থেকেই একটা ইকুয়েশন তৈরি হয়ে যায়। ফলে ‘ঘনচক্কর’য়ে ওর সঙ্গে কাজ করতে সুবিধেই হয়েছে।
‘ঘনচক্কর’-এর মতো ছবি আমার কেরিয়ারে এই প্রথম, যেখানে কমেডিও আছে, থ্রিলারও আছে। এই ছবিতে আমার নাম নীতু। নীতু খুব রঙিন একটা চরিত্র। উচ্ছল, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা হট্টিকট্টি পঞ্জাবি মেয়ে। আমার কস্টিউম ডিজাইন করেছে সুবর্ণা রায়চৌধুরী। সুবর্ণা ‘পরিণীতা’তেও আমার ডিজাইনার ছিল। ও বলেছিল “নরমসরম বাঙালি মেয়ে হিসেবে অত সুন্দর করে সাজিয়েছিলাম তোমাকে। এখন পঞ্জাবি পোশাকে কী ভাবে সাজাই! উগ্র হয়ে যাবে না সাজটা?” আমি ওকে বলেছিলাম, তুমি ‘পরিণীতা’-র ললিতার কথা ভেবো না। বিদ্যা বালনের ইমেজের কথা ভেবো না। |
|
‘ঘনচক্কর’ সিনেমার একটি দৃশ্যে বিদ্যা বালন |
• কিন্তু এই ‘ঘনচক্কর’-এ তো আপনি প্রথমে কাজ করতে চাননি। দোনামনায় ছিলেন।
হ্যাঁ, একটা টানাপোড়েন তো ছিলই। মনে হচ্ছিল আমি বারবার খুব ‘লাউড’ চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করেছি। এর আগে ‘ডার্টি পিকচার’-এর চরিত্রটার উপস্থাপনাও বেশ উগ্র ছিল। কিন্তু পরিচালক রাজকুমার গুপ্তা তখন নাছোড়। বলে বসলেন, আমাকে ছাড়া এ ছবি তিনি করবেন না।
• আপনি মানুষ হিসেবে কতটা উচ্ছল? কখনই বা লাউড হতে ভালবাসেন?
সত্যি বলছি, আমি যখন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে থাকি, তখন খুবই হইহই করি। দুর্দান্ত মজা করি। খুবই রঙিন তখন। কিন্তু বাইরের লোকের সামনে কিছুটা সংযত। যদিও আমি মানুষ হিসেবে সব সময়ই স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার করায় বিশ্বাসী।
• আপনি ইচ্ছে করলেই ওজন কমাতে পারেন, বা বাড়াতে পারেন। ‘ডার্টি পিকচার’-এ ভারী গড়ন আর ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’-য় ছিপছিপে। এটা এত দ্রুত কী করে করেন?
এটা খুব শক্ত কাজ। কিন্তু আমি কখনও ক্র্যাশ ডায়েটিং করি না। নিয়মিত ব্যায়াম করি। আর বাড়ির খাবার খাই। ‘ঘনচক্কর’-এ রাজকুমার আমাকে বলেছিলেন, হট্টাকাট্টা পঞ্জাবি মেয়ের মতো দেখাতে হবে। তাই ওজন কমাইনি। আবার ‘শাদিকে সাইড এফেক্টস’ ছবির জন্য ওজন কমাতে হয়েছে। ব্যায়াম আর খাওয়াদাওয়ার রকমফেরের উপরই ওজন কমা-বাড়া নির্ভর করে।
• আপনার ফ্যাশন নিয়ে অনেক সময়ই খুব সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু এখন আর সেটা হয় না। কী জাদু করলেন?
এটা আর কিছুই নয়। আগে যে সব পোশাক নিজের নজরে ভাল লাগত, তাই কিনে বা বানিয়ে পরে ফেলতাম। এখন বুঝেছি যে পোশাক আমাকে মানায়, সেটাই আমার পরা উচিত। পোশাক দেখতে ভাল হলেই যে আমাকে মানাবে, তা নয়। আমার ফ্যাশন সেন্সটা এ ভাবেই বদলে গিয়েছে।
• রাজকুমার গুপ্তার পরিচালনায় আপনি এর আগে ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ ছবিতেই কাজ করেছেন। তখন থেকেই তো ওঁর সঙ্গে আপনার একটা আলাদা সমীকরণ, আলাদা বন্ধুত্ব...
হ্যাঁ, সেটা তো হয়েইছে। তার কারণ ওর বাস্তবতাবোধ। সেন্স অব রিয়েলিটি। ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’-তে আমার চরিত্র সাবরিনা যখন নিজের বোনের হত্যার মামলার শুনানির দিন কোর্টে গিয়েছে, সেদিন একটা বিশেষ ঘটনায় সে হেসে ফেলে। এমন একটা দুঃখের ঘটনা নিয়ে মামলা চলেছে। তারও মধ্যে হাসি ঢুকিয়েছিলেন রাজকুমার। মানুষ তো হাসবেই। যত বড় দুঃখের মধ্যেই থাকুক না কেন। এটাই তো বাস্তবতাবোধ। ‘ঘনচক্কর’ ছবিতেও সেটা আছে। নীতু খুব বাস্তব। তার সঙ্গে তার স্বামীর যে ঝগড়া, প্রেম, ভালবাসাবাসি হয়, মান-অভিমান হয়, তার মধ্যেই দৈনন্দিনতার ছোঁয়া আছে। নীতুর সঙ্গে প্রত্যেকটা মানুষের সম্পর্কই বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া। একটা কমেডি থ্রিলারের মধ্যেও রাজকুমার রিয়েলিটিকে ধরে রেখেছে। |
|
সিদ্ধার্থের সঙ্গে |
• ‘পরিণীতা’য় বাঙালি মেয়ে, ‘ডার্টি পিকচার’-য়ে দক্ষিণ ভারতীয়, আবার এই ‘ঘনচক্কর’এ পঞ্জাবি। নানা দেশের এত চরিত্রে নিজেকে আলাদা ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য নিশ্চয়ই অনেক হোমওয়ার্ক করতে হয়?
না। তেমন কোনও হোমওয়ার্ক করতে হয় না। মুম্বইতে থাকি । এখানে আমার নানা ভাষায় কথা বলা বন্ধুবান্ধব আছে। বিয়েও হল পঞ্জাবি পরিবারে। সব থেকে বড় কথা, আমি ভারতীয়। যে রাজ্যের মেয়ের চরিত্রেই অভিনয় করি না কেন, শিকড়টা তো ভারতের মাটিতেই থাকছে। মূল সংস্কৃতিটা তো এক। বাঙালি চরিত্র করতে আমার অসুবিধে হয় না, সে ‘পরিণীতা’-র ললিতা হোক বা ‘কহানি’-র বিদ্যা বাগচি। আমি যে মনেপ্রাণে বাংলার সঙ্গে যুক্ত। বাঙালিয়ানা আমার মজ্জায়।
• বাঙালিয়ানা মজ্জায়। কিন্তু মাছ-মাংস তো খান না।
না। মাছ-মাংস খাই না। আমার বর সিদ্ধার্থ খায়। আমার পাশে বসেই। আমার তাতে কোনও অসুবিধে হয় না।
• আপনি যে ধরনের ছবিতে অভিনয় করেছেন, অনেক সময়ই একজন ‘পাওয়ার ওম্যান’ সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘পাওয়ার ওম্যান’ বলতে আপনি নিজে ঠিক কী বোঝেন?
আমার তো মনে হয় প্রত্যেক নারীর মধ্যে সেই শক্তি আছে। এমনকী ‘ঘনচক্কর’-য়ে যে নীতুর মতো হাসিখুশি মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছি, তারও মধ্যে শক্তির প্রকাশ আছে। আমার কাছে শক্তিময়ী নারী সেই, যে নিজের শর্তে নিজের জীবনটা চালনা করতে পারে।
• আপনার নতুন বিবাহিত জীবনে শক্তি বা ক্ষমতার রাশটা কার হাতে ধরা? আপনার, না আপনার স্বামীর?
সংসারে আমি আর আমার স্বামী সমান সমান। কেউ জোর করে কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি না। ক্ষমতার রাশও কারও হাতে ধরা নেই।
• বিবাহিত জীবন কাটছে?
উফফ্। দারুণ। সারা দিন দু’জনেই প্রচুর কাজের মধ্যে থাকি। কিন্তু বাড়ি ফিরে একসঙ্গে গল্প করা, দিনের অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করা, একসঙ্গে খাওয়া, এর মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ আছে। বাড়ি ফেরার একটা আলাদা মানে আছে বিবাহিত জীবনে। কেউ আমার জন্য বাড়িতে অপেক্ষা করছে, এটা ভাবতে খুব ভাল লাগে।
• আপনার যাঁরা অনুরাগী, তাঁদের মধ্যে তো জেন ওয়াই প্রজন্মও আছে। তাঁরা কিন্তু আর আজকাল বিয়েতে তেমন বিশ্বাস করে না। তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
কাউকে মনেপ্রাণে ভালবাসলে বিয়ে করতে বলব। বিয়েতে বা কমিটমেন্টে ভয় পেতে মানা করব। কারণ কারও প্রতি যদি কমিটমেন্ট থাকে, তাতে জীবনে একটা ডিসিপ্লিন আসে। সম্পর্ক বিয়ের দিকে যে আজকাল এগোতে চাইছে না তার কারণ ধৈর্যের অভাব। সম্পর্ককে সময় দিয়ে বোঝা দরকার। |
|
|
|
|
|