২০১১ সালে জনগণনা অনুযায়ী এখন পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যা ৯ কোটি ২৭ লক্ষের বেশি। এর মধ্যে কাজ করতে সক্ষম বা ইচ্ছুক, এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। অর্থাৎ জনসংখ্যার ৩৮ শতাংশকে ‘কর্মী’ বলা চলে। এঁদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ প্রধান কয়েকটি কাজের সঙ্গে যুক্ত, অর্থাৎ বছরের মধ্যে ছয় মাসেরও বেশি সময় কোনও একটি কাজ করেন। অর্থনীতির ভাষায় এঁদের ‘প্রধান কর্মী’ বলা হয়। বাকিরা নানা সময়ে নানা কাজ করেন, কোনও একটি নির্দিষ্ট কাজ সারা বছর করেন না। এঁদের বলা হয় ‘প্রান্তিক কর্মী।’
কিন্তু কী ধরনের কাজ করছেন পশ্চিমবঙ্গের কর্মীরা? দশ বছর আগে যে কাজ তাঁরা করতেন, আজও কি সেই একই ক্ষেত্রে, একই কাজ করছেন?
২০১১ সালের সরকার্যি পরিসংখ্যান বলছে, কৃষিজমি রাজনীতির একটা প্রধান বিষয় হয়ে উঠলেও, জীবিকা হিসেবে কৃষির জনপ্রিয়তা কমছে। বহু মানুষ কৃষিকাজে বাঁধা না থেকে অন্য ক্ষেত্রে কাজ খুঁজছেন। ২০০৩-০৪ সালের হিসেব অনুযায়ী, বীরভূম, বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুরের ৭০ শতাংশ জমি কৃষিতে ব্যবহৃত হত। গোটা রাজ্যে ছিল ৬২ শতাংশ। সেটাই ২০১০-১১ সালে দাঁড়িয়েছে ৫৭ শতাংশে। এই হারে কমতে থাকলে আর দশ বছর পরে কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার হবে রাজ্যের অর্ধেকেরও কম জমি। |
কৃষি থেকে জমি যেমন সরছে, তেমনই সরছে কর্মীরাও। সেই ছবিটা স্পষ্ট হয় যদি সেই গত চার দশকে কৃষিতে নিযুক্ত মানুষদের সংখ্যা দেখা যায়। রাজ্য সরকারের কৃষি দফতরের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ১৯৭৭-৭৮ সালে গ্রামে মোট পুরুষকর্মীর মধ্যে কৃষিকর্মী ছিল ৭৭ শতাংশ। আশির দশক জুড়ে সংখ্যাটা ৭২ শতাংশে ছিল। পরবর্তী দুই দশকে গ্রামের পুরুষ কর্মীর ৬৪ শতাংশের কাছাকাছি চাষের কাজ করেছেন। আর ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা যাচ্ছে, কৃষিতে পুরুষকর্মী কমে দাঁড়িয়েছে ৫৭ শতাংশে। কৃষিকাজ থেকে সরে এসেছেন মেয়েরাও। চার দশক আগে ৬৮ শতাংশ মহিলাকর্মী চাষের কাজই করতেন, এখন করেন ৫০ শতাংশ।
রাজ্যের এই ছবি গোটা ভারতের ছবিরই প্রতিফলন। গত চার দশক ধরেই মোট জনসংখ্যার অনুপাতে কৃষক কমছিল, কিন্তু এ বছর প্রথম দেখা গেল, কৃষকদের মোট সংখ্যাও কমেছে। জনগণনা বলছে, এ দেশে দশ বছরে ৯০ লক্ষ কৃষক কমেছে। মোটামুটি ভাবে কৃষিকাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের তিনটি শ্রেণি করা যায়, যাঁরা নিজের জমিতে চাষ করেন, যাঁদের প্রধান কাজ কৃষিমজুরি (বছরের অধিকাংশ সময় মজুরি করেন), এবং যাঁরা প্রান্তিক কৃষিমজুর (ছয় মাসের কম মজুরি করেন)। কৃষকদের সংখ্যা কমে কৃষিমজুরদের সংখ্যা বেড়ে চলছিল অনেক দিন ধরেই, এখনও কমছে। সেই সঙ্গে, প্রান্তিক কৃষিমজুরদের একটা বড় অংশ সরে গিয়েছে কৃষিক্ষেত্র থেকেই। খেতমজুরি করার চাইতে ভাল কাজ পাচ্ছেন তাঁরা।
সেটাই স্বাভাবিক। চাষিরা দুঃখ করে বলেন, ‘চাষ আর লাভজনক নেই,’ সেই একই কথা বলছে সরকারি হিসেবও। কেন্দ্রের হিসেব, ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরে জাতীয় আয়ে কৃষির অংশ ১৩ শতাংশের বেশি হওয়া কঠিন। রাজ্যের হিসেব, ১৯৯১ সালের পর রাজ্যের মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশের নীচে থাকে কৃষি। এই সময়টাতে কৃষিতে রোজগার বেড়েছে ৩.৪ শতাংশ হারে, যেখানে শিল্পের ক্ষেত্রে রোজগার বৃদ্ধির হার তার দ্বিগুণ (৬.৬ শতাংশ), পরিষেবার ক্ষেত্রে তারও বেশি (৭.৭ শতাংশ)। ফলে কৃষি থেকে অন্য ক্ষেত্রে যাওয়ার প্রবৃত্তি বাড়ছে।
সমস্যা এই যে, পরিষেবা ক্ষেত্রে নিয়োগের জন্য যে ধরনের দক্ষতা দরকার হয়, কৃষি-নিযুক্ত পরিবারের সদস্যদের পক্ষে তা আয়ত্ত করা সহজ নয়। যদি উপযুক্ত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়, যাতে কৃষি পরিবারের সদস্যদের একটি বড় অংশকে আনা যায় শিল্প বা পরিষেবা ক্ষেত্রে, তা হলে রাজ্যবাসীর দারিদ্র যেমন কমবে, তেমনই পশ্চিমবঙ্গ দেশের সম্পন্ন রাজ্যগুলির মধ্যে স্থান করে নিতে পারবে।
আর কৃষিতে যাঁরা থাকবেন? তাঁদের জন্য কৃষিকে আরও উৎপাদনশীল করে তুলতে হবে, উন্নত বীজ, চাষের আধুনিক পদ্ধতি এবং নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে। কত একর জমিতে চাষ হবে, তার চাইতেও বড় প্রশ্ন হয়ে উঠবে, প্রতি একরে কত ফসল উৎপাদন হবে, কোন ফসল সব চাইতে লাভজনক হবে। |