মেয়েরা অর্ধেক আকাশ, কথাটা বলেছিলেন চিনের নেতা। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনে অর্ধেক আসন মেয়েদের দিয়েছে ভারত। পশ্চিমবঙ্গে এ বছর পঞ্চায়েতের ৫০ শতাংশ আসনের জন্য লড়ছেন মেয়েরা।
কিন্তু রাজ্যের তিন কোটিরও বেশি মেয়ে, যাঁরা বাস করেন গ্রামে, তাঁদের তাতে কিছু লাভ হবে কি? গত দু’দশকে মহিলা সদস্যরা ছিলেন এক-তৃতীয়াংশ। তাঁরা যদি মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারতেন, তা হলে কি কালচিনির চা বাগান
থেকে বসিরহাটের ইটভাটা, সর্বত্র মেয়েরা পাচার হয়ে যেত? মেয়ে পাচারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ভারতের প্রায় শীর্ষে। মুম্বই, পুনে, বেঙ্গালুরুর মতো বড় বড় শহরের নিষিদ্ধ এলাকা থেকে প্রতি সপ্তাহে উদ্ধার হয় যে সব মেয়েরা, তাদের ফিরিয়ে আনা হয় ক্যানিং, বহরমপুর, করিমপুরে। কী করছেন তবে মহিলা প্রধান, সভাপতি, সভাধিপতিরা? কী লাভ হবে আরও বেশি মহিলা পঞ্চায়েতে এনে?
মালদহের সীমান্তঘেঁষা ব্লক বামনগোলার মদনাবতী গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বন্দনা পোদ্দার দে বলেন, “আমার এলাকায় নারী পাচার আটকাতে অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু বন্ধ করতে পারিনি। বাইরের রাজ্য পাচারচক্রের পান্ডারা গরিব পরিবারের মেয়েদের বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়ে মোটা টাকা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পরে তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।” আরও স্পষ্টবক্তা মাদারিহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য কালী লোহার। বললেন, ‘‘মেয়েদের ফিরে পেতে পরিবার আমার কাছে এলে পুলিশের সাহায্য চাই।
এর বাইরে তেমন কোনও কাজ করিনি।”
বালিকা ও নারী পাচার রুখতে গ্রাম পঞ্চায়েত কী করতে পারে, তার একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখাও রয়েছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েদের নিয়ে প্রচার, বাইরে কাজের খোঁজে-যাওয়া মেয়েদের ঠিকানা রাখা, বিয়ে নথিভূক্ত করা, গ্রামে মেয়েদের রোজগারের সুযোগ তৈরি। সেটুকু করতে পারছেন, দাবি করলেন করিমপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নিশা সরকার। বললেন, “যাঁরা কাজে বাইরে যান তাঁরা কার সঙ্গে, কোথায় যাচ্ছেন, কী কাজ, এ সব কিছুরই আমরা খোঁজ রাখি। তবু পুরোপুরি সফল হয়েছি, বলা যাবে না।”
সন্দেশখালি ১ ব্লকের সেহেরা-রাধানগর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান গীতা মণ্ডল বললেন, “আমরা ভিন রাজ্যে যাওয়া আটকাতে চাইলে মেয়েরা বলত, খাব কী?” পুকুর কাটা, রাস্তা তৈরির মতো কাজের সঙ্গে সঙ্গে আশা কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর কাজ মেয়েদের দেওয়ায় বাইরে যাওয়ার প্রবণতা কমেছে, জানালেন তিনি।
মুর্শিদাবাদের রানিতলা থানা এলাকায় নশিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রধান ইসমেতারা বিবি দারিদ্র কমাতে পারেননি, কিন্তু পাচার কমিয়েছেন প্রধানত পুলিশের সক্রিয়তা আর পঞ্চায়েতের উদ্যোগে। “কয়েক বছর আগেও নশিপুর ও লাগোয়া বালাগাছি গ্রাম থেকে পাচার হওয়া মহিলাদের ১১০০ টাকা থেকে ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে ভিন রাজ্যে। গত পাঁচ বছরে কিন্তু মাত্র এক জন তরুণী পাচার হয়েছে।” স্বনির্ভর গোষ্ঠার মেয়েদের নিয়ে বৈঠক করে লাভ হয়েছে, বলেন তিনি।
কিন্তু রাজ্যের পাচারচিত্রই বলে দিচ্ছে, দালালদের আটকাতে পঞ্চায়েত অনেকটাই ব্যর্থ। পাচার প্রতিরোধে পঞ্চায়েতের সঙ্গে দীর্ঘ দিন কাজ করছেন ‘জবালা’ সংস্থার বৈতালী গঙ্গোপাধ্যায়। বলেন, “ঝুঁকিপ্রবণ পরিবারগুলিকে চিহ্নিত করা, তাদের স্বনির্ভর দলের মধ্যে নিয়ে আসা, বাইরে-যাওয়া মেয়েদের ঠিকানা নথিভূক্ত করা, এই কাজগুলোয় খামতি রয়ে যাচ্ছে। যে মেয়েরা পাচার হওয়ার পর ফিরে আসছে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য পঞ্চায়েতের মহিলাদের উদ্যোগ তেমন নেই।”
পঞ্চায়েতের নারী-শিশুকল্যাণ উপসমিতির সঞ্চালকরা প্রায়ই নিষ্ক্রিয় থাকেন। পাচারপ্রবণ এলাকাতেও গ্রাম সংসদ, গ্রাম সভায় প্রসঙ্গটি তোলা হয় না। ‘ব্যস্ত আছি’ বলে পাচার প্রতিরোধের কর্মসূচি এড়িয়ে যান মহিলা সদস্যরাও।
তা হলে আরও মেয়ে পঞ্চায়েতে এসে লাভ হবে কি? এ বিষয়ে কিন্তু প্রত্যয়ী বন্দনা, ইসতেমারা। তাঁদের বক্তব্য, যত বেশি মহিলা আসবেন পঞ্চায়েতে, তত বেশি জানবেন মহিলাদের অধিকার বিষয়ে, জানাতে পারবেন আশেপাশের মেয়েদের। মহিলা প্রধানরাই নিয়মিত বৈঠকে নারীপাচারের মতো বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দেন। মেয়েদের পরিবারও সহজে তাঁদের কাছে বিষয়টি জানাতে পারেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে মহিলা সদস্যরা রুখে দিয়েছেন পাচার, নাবালিকার বিয়ে, এমন উদাহরণও প্রচুর।
পঞ্চায়েতে মেয়েদের সদস্যপদ যে পাচারের মতো অপরাধের প্রতিকার করার সুযোগ তৈরি করেছে, তা নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকার মেয়েরাও ওয়াকিবহাল। অর্ধেক আসনে মেয়েরা এলে সেই সম্ভাবনা শেষে বাস্তব হবে কি না, তা বলবে অষ্টম নির্বাচন। |