অনেক কষ্টে বাড়ির মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া গিয়েছিল।
ও পাশ থেকে ‘হ্যালো’ শুনেই ককিয়ে উঠেছিল এগরা থেকে আসা কৃষ্ণকলি-“আমি এখানে পড়ব না। বাড়ি যাব।”
পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা থেকে ছেলেটি পড়তে এসেছিল কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৬ সালে। কৃষ্ণকলি মাইতির কথায়, “মেস পাইনি। আর্থিক সমস্যা ছিল। ক্যাম্পাসের বাইরে কোনও ভাল বন্ধু ছিল না।” দ্বিতীয় বর্ষেই পড়া অসমাপ্ত থাকে তাঁর। এখন অবশ্য বেসরকারি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্মাতকস্তরের পড়া সম্পূর্ণ করছেন।
ব্যতিক্রমী দৃশ্য নয়। প্রতি বছরই গ্রামবাংলার বহু ছেলেমেয়ে ভাল নম্বর পেয়ে ভর্তি হন কলকাতার নামী কলেজগুলিতে। কিন্তু মানিয়ে নিতে হিমশিম খেয়ে যান।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং থেকে কলকাতার আশুতোষ কলেজে পড়তে আসা অভিষেক দেবনাথের কথায়, “কলকাতার রাস্তাঘাট ভাল চিনি না। বন্ধুও খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমরা যে পরিবেশে বড় হয়েছি সেটা আলাদা।” যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঋকদেব ভট্টাচার্যের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে। তাঁর মতে, “গ্রাম থেকে শহরের কলেজে এলে ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত সমস্যা হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বাংলা বিভাগে এই সমস্যা না হলেও ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যের মতো কিছু বিভাগে এই সমস্যা হয়।”
অনর্গল ইংরেজি বলতে না পারা এবং ইংরেজি ভাষায় দেওয়া ‘ক্লাস লেকচার’ বুঝতে না পারা হল গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের অন্যতম প্রধান সমস্যা। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র বিভাকর সরকারের বাড়ি বালুরঘাটে। বিভাকর বলেন, “প্রথমে ইংরেজি বুঝতে সমস্যা হত। ক্লাসে চুপচাপ বসে থাকতাম।”
বাড়ির লোকজনকে কাছে না পাওয়ার কারণেও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন অনেকে। বর্ধমানের সৃজাতা দে পড়েন বাগবাজার উইমেন্স কলেজে। সৃজাতার কথায়, “বাইরে থেকে পড়াশুনা করলে কখনই বাড়ির পরিবেশ পাওয়া যায় না। পরিবারের সদস্যদের অভাব অনুভব করি।” তাঁর মনে হয়, “অনেক কলেজেই বন্ধুত্বের মধ্যে লুকিয়ে থাকে রাজনীতি।” ঋকদেবও বলেন, “অনেক সময়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদের সামনে রেখে, তাঁদের আবেগকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন।” |
যোগাযোগ |
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
ভর্তির সময়ে মার্কশিট, প্রাপ্ত নম্বর সংক্রান্ত সমস্যা হলে-
ফ্যাকাল্টি অফ আর্টস (সেক্রেটারি) - ০৩৩ ২৪৫৭২২১২
ফ্যাকাল্টি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (সেক্রেটারি)- ০৩৩ ২৪৫৭২২১৫
ফ্যাকাল্টি অফ সায়েন্স (সেক্রেটারি)- ৯৪৩৩১ ৪৪৫৪৮
ভর্তির সময় অর্থকরী সমস্যা হলে বা র্যাগিং সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ থাকলে যোগাযোগ করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফ স্টুডেন্টের সঙ্গে। অর্থকরী সমস্যায় ফ্যাকাল্টি সেক্রেটারি সঙ্গেও যোগাযোগ করা যাবে। |
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
ভর্তির সময়ে মার্কশিট, প্রাপ্ত নম্বর, অর্থকরী কোনও সমস্যা হলে সংশ্লিষ্ট কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। র্যাগিংয়ের সমস্যা হলেও কথা বলতে হবে অধ্যক্ষের সঙ্গেই। |
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
ভর্তির সময়ে মার্কশিট, প্রাপ্ত নম্বর, অর্থকরী কোনও সমস্যা হলে ডিন অফ স্টুডেন্ট, রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
ডিন অফ স্টুডেন্ট দেবশ্রুতি রায়চৌধুরী ৯৪৩০৫ ৪৩৪৭৩। র্যাগিংয়ের সমস্যা হলেও কথা বলতে হবে তাঁর সঙ্গেই। |
|
প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলের প্রতিটি হল কিংবা ওয়ার্ডেই বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য। হস্টেলের ‘সিনিয়র’ ছাত্রদের হাত ধরেই গ্রাম থেকে আসা কোনও ছেলে কিংবা মেয়ে জড়িয়ে পড়ে ছাত্র রাজনীতিতে। অনেক মধ্যমানের কলেজে ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের থেকে অতিরিক্ত চাঁদা নেওয়া হয় বলেও অভিযোগ।
এখানেই শেষ নয়। কলকাতার বহু কলেজেই ভর্তি প্রক্রিয়ার পুরোটাই ‘অনলাইন’। অথচ, বহু গ্রামেই নেই ইন্টারনেট। হাওড়ার দালালপুকুর পলিটেকনিক কলেজের সদ্য প্রাক্তন ছাত্র, এগরার ধীমান মাইতি বলেন, “অনেক গ্রামেই সাইবার কাফে নেই। ফলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা শহরের ভাল পলিটেকনিক কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়াতেই যোগ দিতে পারে না।” তাঁর কথায়, “কোনও সমস্যায় পড়লে কোনও ছাত্র বা ছাত্রী একা অধ্যক্ষের কাছে যেতে গেলে কলেজের অফিস তাঁকে আটকে দেয়। অথচ ইউনিয়নের সঙ্গে গেলে কিছু বলে না।”
সব ছাত্র সংগঠনই অবশ্য দাবি করছে, তারা ছাত্রছাত্রীদের পাশে আছে। এসএফআইয়ের রাজ্য সভাপতি মধুজা সেনরায় বলেন, “গ্রাম থেকে যাঁরা শহরের কলেজে আসে, আমাদের সংগঠন তাঁদের পাশে আছে।” টিএমসিপি-র রাজ্য সম্পাদক (বিশ্ববিদ্যালয় পর্যবেক্ষক) অম্লান মণ্ডল জানান, গ্রাম থেকে যাঁরা পড়তে আসে তাঁদের জন্য যে সরকারি সাহায্যগুলি রয়েছে, সেগুলি নিয়ে তাঁরা ক্যাম্পাসের মধ্যে প্রচার করেন। ডিএসও-র রাজ্য সম্পাদক অংশুমান রায়ের বক্তব্য, “গ্রামের দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের আমরা সংগঠনগত ভাবে সাহায্য করি। তবে রাজ্য সরকার কলেজে ভর্তির ফি বাড়ানোয় আরও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকেরাও বিষয়টি সম্যক জানেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বাসব চৌধুরী বলেন, “গ্রামের পিছিয়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করলে ভাল। গ্রাম থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা শোনা, সমাধানের পথ বাতলে দেওয়ার জন্য কলেজে ‘মেন্টর’ রাখা উচিত। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককেও উন্নত করতে হবে।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফ স্টুডেন্ট রজত রায়ের কথায়, “সমস্যা হলে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। শহরের বেশ কিছু নামী কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইদানীং মাদকদ্রব্য সেবনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়ে সর্তক থাকতে হবে।” একা বোধ করলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এনসিসি ও শহরের অন্য সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফ স্টুডেন্ট দেবশ্রুতি রায়চৌধুরী বলেন, “ইংরেজি বোঝার সমস্যা মেটানোর জন্য গত বছরেই ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আমরা একটি কোর্স করিয়েছিলাম। তবে উচ্চশিক্ষায় ইংরেজির কোনও বিকল্প নেই। ইংরেজি খবরের কাগজ, ইংরেজি সিনেমা, ইংরেজি খবরের চ্যানেল দেখা অভ্যাস করতে হবে।”
সমস্যা জয় করে সাফল্যের পথে হাঁটতে সচেষ্ট অনেকেই। প্রেসিডেন্সির বিভাকরের কথায়, “পরিবেশ আলাদা বলে ক্লাসে চুপচাপ বসে থাকলে হবে না। কথা বলতে হবে। সমস্যা হলে জানাতে কবে কলেজ কর্তৃপক্ষকে।” আশুতোষ কলেজের অভিষেক দেবনাথ বলেন, “নিজের উপরে ভরসা রাখাটাই সবচেয়ে জরুরি।” |