জাস্টযাচ্ছি

যাও, যেখানে খুশি যাও। বাঘে খাবে তোমাকে। বলে দিলাম।’ জঙ্গলের রাস্তার দিকে হাত ছুড়ে দিয়ে কথাটা বলল যে, সে সন্ন্যাসী না ভিখিরি, বোঝার উপায় নেই। ময়লা গেরুয়া রঙের লুঙ্গি, একটা লাঠি আর কাপড়ের ঝোলা ছাড়া কিছুই নেই ওর। রাস্তার এক পাশে বসে আছে। সামনে শিবের ছবি, তার পাশে কিছু পয়সা পড়ে আছে। কিছু দূরে পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে, নর্মদা নদী দেখা যাচ্ছে। আর একটু দূরে ওঙ্কারেশ্বর শহর, মন্দির, লোকজনও ঠাহর হচ্ছে। ঘণ্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। আমি ওখান থেকেই আসছি। ঠাকুর-দেবতার জায়গা এটা, আমার অবশ্য ধর্মকর্মের ব্যাপার নেই। এমনিই এসেছি। ঘুরতে ঘুরতে। তবে ভালই লাগছে। পাহাড়, গাছপালা আছে। নীল নর্মদা বইছে পাশ দিয়ে। আসলে শীতকালে সব জায়গাই ভাল লাগে।
আগে শুনেছিলাম, এখানে এসে আরও শুনলাম, নর্মদাকে পরিক্রমা করে অনেকে। এখান থেকে অমরকণ্টক, যেখানে নর্মদার উৎস। তার পর ফেরা। তিন বছর, তিন মাস, তেরো দিন লাগে। পাহাড়, জঙ্গল, খাদের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। মাঝেমধ্যে গ্রাম পড়ে। সেখানে, মন্দিরে থাকার জায়গা পাওয়া যায়, খাবারও। ওঙ্কারেশ্বরে চায়ের দোকানে আর একটা আলোচনা শুনছিলাম। কিছু দূরে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হচ্ছে, বাঁধ তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে। আটকে গেছে নদী। কোথাও বন্যা হয়ে ভেসে গেছে জমি লোপাট হয়ে গেছে অনেক গ্রাম। কিন্তু এ সব করলে পরে মানুষের ভাল হবে, বলেছিলাম রাস্তায় হাত পেতে থাকা মানুষটাকে। সে ভয়ানক রেগে শাপ দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। হয়তো তার ঘর ছিল ওখানে।
রাস্তা না চিনলেও ক্ষতি নেই। কারণ রাস্তা একটাই। কখনও নেমে গেছে নদীর তীরে, অল্প বালি-মাটি সেখানে, বড় বড় পাথর। কখনও নদীকে অনেক নীচে ফেলে রেখে, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। গাছ-পাতার শিরশির, ঝিঁঝির ডাকে চাপা পড়ে গেছে জলের শব্দ। আওয়াজ শুনে বোঝা যায় হনুমান আছে প্রচুর। এখনও অবধি একটাও লোক দেখতে পাইনি, গ্রামও নয়, হয়তো আছে আরও পরে। রাস্তার ওপর ছেঁড়া রিবন, ধুলোয় মাখা জরির পাড়, মরা বিড়ির টুকরো।
ছবি: শুভময় মিত্র
জঙ্গল শেষ হতেই জায়গাটা বড় হয়ে গেল। একেবারে ফাঁকা। উঁচুনিচু অনাবাদি জমি, মরা সবুজ পাহাড়, নদীটা কোথায় চলে গেছে কে জানে! আকাশ ঘন নীল, একেবারে পরিষ্কার। শুধু অনেক দূরে, যে দিক থেকে এসেছি, ওঙ্কারেশ্বরের ওপর এক টুকরো মেঘ। তার চেহারাটা শিবের জটার মতো, ভাবতে চেষ্টা করলাম। মিলল না। কেন জানি না, একটু ভয় করতে লাগল। যদিও ভয়ের কোনও কারণ নেই, ফাঁকা মাঠে নিশ্চয়ই বাঘ আসে না। তা ছাড়া লোকজন যাওয়া আসা করে এখান দিয়ে। ভাবতে ভাবতেই এসে পড়ল একটা দল, উলটো দিক থেকে। পাগড়ি পরা, লাঠি হাতে একটা বুড়ো, সাদা জামা পরা। পিছনে জনা সাতেক মহিলা, সবার মুখে সাদা কাপড় বাঁধা। কিন্তু শাড়ি নানা রঙের। শেষে আসা মহিলা আমাকে দুটো লাড্ডু দিল। কেউ থামল না, চলে গেল হন্তদন্ত হয়ে। লাড্ডুতে কামড় দিয়েই বুঝলাম ভয়ানক জলতেষ্টা পেয়েছে। সঙ্গে জলের বোতল নেই। এ দিক ও দিক তাকাচ্ছি, হঠাৎ দেখি পাশেই খাদ, নীচ দিয়ে বইছে নদী। নামলাম আস্তে আস্তে। আঁজলা করে নদীর জল তুলে খেলাম। জীবনে প্রথম বার।
সঙ্গে ঘড়ি নেই, কিন্তু মনে হল দুপুর ফুরিয়ে আসছে। রোদটা অন্য রকম। ঠান্ডা হাওয়া আসছে পাহাড় পেরিয়ে। দূরে শুকনো ডাল কেটে বেড়া দেওয়া হয়েছে মনে হল, লালচে মাটির বাড়ির দেওয়ালও দেখতে পেলাম। এগোলাম আস্তে আস্তে, ওখানেই থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। জায়গার নামটা তখন জেনে নেওয়া যাবে। মনে হল গরুর ডাক শুনতে পেলাম। সন্ধের মুখে গ্রামে ঢুকলাম। একটাও লোক নেই। কারও গলার শব্দও শুনতে পাচ্ছি না। স্রেফ কয়েকটা বাড়ি ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। একটা মুরগি খসমস করে ঢুকে গেল ঝোপের মধ্যে। মন্দিরজাতীয় বাড়ি চোখে পড়ল। বন্ধ। পাশে টিউবওয়েল, জল আছে। দ্বিতীয় লাড্ডুটা বের করলাম। এক পাশে শুকনো ডালপালা বেঁধে তৈরি করা ঘর। খড়ের ছাদ। ঢোকার দরজা আছে, পাল্লা নেই। ভেতরে অন্ধকার, গোবরের মতো গন্ধ আসছে, ওখানেই রাতটা কাটাব ঠিক করলাম। উপায় নেই। সকাল হলেই কেটে পড়ব।
চাঁদ উঠল বিনা নোটিসে। ঠান্ডা নামল ঝপ করে। কিছুই নেই সঙ্গে। ক্লান্তিটা আছে, ঘুমিয়ে পড়া যাবে যা হোক করে। আগুন জ্বালালে হয়। চাঁদনি অন্ধকার হাতড়ে কাঠিকুটো জোগাড় করলাম, বড় কাঠি আর কোথায় পাব? ওই সব সাজিয়ে আগুন জ্বালাব খেয়াল হল দেশলাই নেই। এমন হতাশ আমি প্রায়ই হই, তাই মাথা দিলাম না। লাথি মেরে ভেঙে দিলাম নিজের বানানো আগুন ধরানোর বাসা। তখনই চোখে পড়ল, টিমটিমে আলো জ্বলছে অনেক দূরে। হয়তো ওটাই গ্রাম। এটা নয়। হয়তো লোকজন ছেড়ে চলে গেছে সব কিছু। কেন কে জানে।
ঠান্ডা লাগছিল, ভেতরে এসে বসলাম মাটির ওপর, পাতবার কিছু নেই। দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে ঝিরঝিরে চাঁদের আলো এসে পড়েছে সেখানে। নীলচে সাদা কালো জ্যোৎস্নার আঁকিবুকি আমার শরীরেও। ভাবছিলাম, গ্রামের নামটাও জানা হল না। না কি সেটাও গ্রামের লোক সঙ্গে নিয়ে চলে গেছে নতুন ডেরায়? শুয়ে পড়লাম, যতটা সম্ভব নিজেকে ছোট করে, ঠান্ডাটা বাড়ছে।
ঘুম আসছিল না, আসার কথাও নয়। চাঁদের দিকে পিঠ করে, শুয়েও আলোটা টের পাচ্ছিলাম, ক্রমাগত বাড়ছিল। চোখ বন্ধ করলেও, চোখের মধ্যে অন্ধকার একটা স্টেজ। তাতে প্রচুর জোনাকির আনাগোনা। এক জোড়া জোনাকি হঠাৎই লাল। চোখ খুললাম। আলো কমে গেছে ঘরের মধ্যে। মেঘ এসেছে? চাঁদকে আড়াল করল কেউ? পাশ ফিরলাম। ঠান্ডা হাত পা-র ওপর একটা গরম চাদর চাপা পড়ল যেন। মস্ত বড় কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে ঘরের বাইরে। দেওয়ালের ঠিক পাশে। স্থির হয়ে। জানোয়ার নিশ্চয়ই। কিছুই করার নেই আমার, চুপ করে শুয়ে থাকা ছাড়া। কাউকে চেঁচিয়ে ডেকেও লাভ নেই। উঠে, বাইরে দৌড়নোর কোনও মানে হয় না। ছায়াটা নড়ছে, চলছে যেন। মাটির ওপর পায়ের ভারী শব্দটাও শুনতে পেলাম এক বার। ছায়াটা আর একটু এগোল। তার পর আর একটু। এর পর এগিয়ে বাঁয়ে ঘুরে কয়েক পা পরেই খোলা দরজা। ভয়ের একটা সীমানা থাকে। তার পরে সবটাই শূন্য হয়ে যায়। ভয় পাওয়া বা না পাওয়ার কারণটাই হারিয়ে যায় অন্ধকারে। চোখ বুজে ফেললাম। চেষ্টা করছিলাম নিজেকে আরও ছোট করে ফেলার। একেবারে পোকার মতো ছোট হওয়া যায় কি?
পায়ের শব্দটা পাচ্ছি। ঘরের আলো বেড়েছে আবার। জানোয়ারটা সরে গেছে। খুব আস্তে আস্তে এগোচ্ছে দরজার দিকে। এখন দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে। আমি নিশ্চিত ভাবেই জানি যে সে বুঝে গেছে ভেতরে কেউ আছে। চোখ বুজে ফেললাম আবার। কানকে বন্ধ করা যায় না। শব্দ এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। শরীরকে সুইচ অফ করা যায় না। টের পাচ্ছি ভারী পায়ের এগিয়ে যাওয়া। পাক খাচ্ছে আমার চার পাশ দিয়ে, নিশ্চয়ই দেখে নিচ্ছে ভয়ে কুঁকড়ে থাকা, মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া, চাঁদের আলোর চিকরিমিকরি-মোড়া, জ্যান্ত, নিশ্বাস ফেলতে ভয় পাওয়া শরীরটাকে। এক সময় শেষ হল পরিক্রমা। থেমে গেছে সে। আতঙ্কের ক্লান্তিতে অদ্ভুত এক ঘুম নেমে এল আমার শরীরে। ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারা যায় সকাল হয়ে গেছে। চোখ খুললাম। নিশ্চিন্তে। দেখি এক জোড়া বাঁকানো শিং, তাতে আবার জরির পাড় দেওয়া হলুদ লাল কাপড় বাঁধা। আর এক জোড়া কাজল পরা বড় বড় চোখ। ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.