|
|
|
|
|
|
লুইসা ভালেনসুয়েলা
আর্জেন্তিনা |
প্যান্থারের চোখ
|
প্রথম গল্প |
অন্ধকার করিডরের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে ওরা। হঠাৎ মেয়েটা ঘুরে দাঁড়ায়, লোকটা আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। মেয়েটা বলে, ‘কী হল!’ লোকটা বলে, ‘তো-তোমার চোখ দুটো বুনো জন্তুর মতো জ্বলছে!’ ‘যাঃ! ঠিক করে দেখুন’, মেয়েটা বলে। তখন অবশ্য চোখ দুটো এমনি, যেমন হয়। সে, পুরুষটির মুখোমুখি, আর ঘন, শান্ত অন্ধকার। লোকটা হাতড়ে হাতড়ে আলো জ্বালায়। মেয়েটার চোখ বন্ধ। নিশ্চয়ই হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছে। কিন্তু লোকটার ভেতরের ধড়ফড়ানি থামে না কিছুতেই।
ওই জ্বলজ্বলে চোখের মুখোমুখি হওয়ার পর থেকে কথাবার্তা বদলে যায়। অফিসের দৈনন্দিন আলোয়, আলোওয়ালা সবুজ চোখ এখন পাতি বাদামি। চাকরিটা ওকেই দিতে চায় লোকটা, কিন্তু মধ্যিখানে এসে পড়ল জ্বলজ্বলে সবুজ। অফিসের বাইরেটা কোরিয়েন্টেস অ্যাভিনিউয়ের মতো হাবিজাবি কিন্তু পরিকল্পিত। ভেতরে এক জোড়া চকচকে চোখ থেকে তৈরি হচ্ছে জঙ্গলের শব্দ। দাঁড়ান দাঁড়ান, এ ভাবে গল্পটা শুরু করলে, ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়েও আমরা কোথাও পৌঁছতে পারব না। জানলাটা খোলা আছে। সেটা হয়তো জঙ্গলের শব্দ শুনতে পাওয়ার কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারে। কিন্তু করিডরে ঠিকরে পড়া চোখের আলো ব্যাখ্যা করা যাবে কী করে, জানলা দিয়ে আসা আলো আর জমাট অন্ধকারের মাঝখানে তো ছিল একটা বন্ধ দরজা।
করিডরের মধ্যে মেয়েটি যে মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর তার পরেই, ওই আলোর চোখ। কেন ওর দিকে তাকিয়েছিল? কী চাইছিল ওর কাছে? কী খুঁজছিল ওর মধ্যে? যদি না চেঁচাত তখন... অফিসের এই পনেরো তলায় বসে কথা চালিয়ে যেতে যেতেই নিজেকে প্রশ্ন করে লোকটা, এক জোড়া চোখের সঙ্গে কথা বলে চলে, সত্যিই জানে না কী বলছে, কী তার কাছে চাওয়া হচ্ছে, আর কোথায় সেই ফাঁদ, যা থেকে সে আস্তে, সড়াৎ করে, পিছলে গেছে। বুনো জন্তুর চোখ। পিছনে খোলা জানলা রেখে কথা বলে আর ভাবে, যদি আর্তনাদটা চেপে রাখতে পারত কিংবা আর একটু তলিয়ে দেখত... |
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
দ্বিতীয় গল্প |
তখন রাত তিনটে, বুঝলে মেয়েটা! সন্দেহজনক একটা শব্দে তোমার ঘুম ভেঙে গেল, আর একদম চুপ করে পড়ে রইলে বিছানায়। শুনতে পেলে, টের পেলে, বেডরুমেই কেউ ঘোরাঘুরি করছে। একটা লোক। লোকটা দরজাটাকে দুমড়েছে, এ বার তোমাকে দুমড়াতে চায়। কার্পেটের ওপর তার পায়ের মৃদু শব্দ, হাওয়ায় হালকা নড়াচড়া। হঠাৎই তোমার ভেতর কী যেন একটা, ভয়ের অনুভূতিকে ছাপিয়ে ওঠে (নাকি, সেইটেই ভয়?) এবং তুমি অন্ধকারের মধ্যে ঘুরে লোকটার একদম মুখোমুখি। হয়তো তোমার চোখের জ্বলে ওঠা দেখেই লোকটা আঁতকে জানলা দিয়ে ঝাঁপ মারে। ভ্যাপসা, তাই হাট করে খোলা ছিল জানলাটা।
দুটি প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে উঠতেই পারে
ক) আগের গল্পে যে ছিল, তুমি কি সেই মেয়েটাই?
খ) পুলিশ জেরা করলে তোমার বাড়িতে ওই লোকটার উপস্থিতি নিয়ে কী বলবে?
|
‘ক’-এর উত্তর
হ্যাঁ, তুমি সেই আগের গল্পের মেয়েটাই। সেই কারণে, সকাল ন’টা অবধি অপেক্ষা করে, তুমি চোখের ডাক্তার দেখাতে যাও। ডাক্তারবাবু পেশাদারি ঢঙেই তোমার ওপর একের পর এক পরীক্ষা করেও দৃষ্টিশক্তিতে গোলমেলে কিছুই পান না। ‘আরে দৃষ্টিশক্তির ঝামেলা এটা নয়’, বলো তুমি। এ বার তোমার চোখের গভীরে পরীক্ষা করে দেখেন, খুঁজে পান ঘাপটি মেরে থাকা একটা কালো চিতা। এর কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেন না তিনি। তুমি থম মেরে বাড়ি ফিরে আসো। নিজেকে শান্ত করতে চিমটে দিয়ে মুখের লোম সাফ করতে থাকো। তোমার ভেতরে চিতাটা গর্জন করতে থাকে, তুমি শুনতে পাও না।
|
‘খ’-এর উত্তর জানা যায় না।
কালো প্যান্থারের সবুজ চোখ, যা অন্ধকারে জ্বলে, আয়নায় দেখা যায় না। হয়তো শুরুতে ভাবা হয়েছিল দেখা যাবে, আদৌ কোনও শুরু যদি থেকে থাকে। প্রথম গল্পের লোকটা এখন মেয়েটার বস। কিন্তু ওকে কিছু করতে বলার সাহস সে এখনও পায়নি। হঠাৎ যদি আলো নিভিয়ে আবার মুখোমুখি দাঁড়ায়! একটাই বাঁচোয়া, মেয়েটার শরীরের অন্য কোথাও থেকে প্যান্থারটা বেরিয়ে আসে না। এ ভাবে শান্তিতেই দিন কাটে, ভয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেলে যেমন হয়। লোকটা সাবধান হয়েই চলে। রোজ অফিস থেকে বেরনোর আগেই ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের অফিসে ফোন করে জেনে নেয় লোডশেডিংয়ের সম্ভাবনা আছে কি না। জোরালো একটা টর্চ সব সময় হাতের কাছে রাখে। জানলাটা সারা ক্ষণ খুলে রাখে, এবং আগের সেক্রেটারিগুলোর মতো এই মেয়েটাকে নিয়ে কোনও অন্ধকার মতলব মনে আনে না। যদিও ভালই লাগত মেয়েটাকে নিয়ে ডিস্কে যেতে, তার পর বিছানায়। ফের ওই দুটো চোখ দেখতে পাওয়ার ভয়ে এ সব আনন্দ-ফুর্তি থেকে দূরে থাকে। শুধু একটা ভাবনার ছাড় নিজেকে দেয়: সত্যিই কি সে দেখেছে ওই জ্বলন্ত চোখ, না গোটাটাই কল্পনা করে নেওয়া? নিজের কল্পনাশক্তিকে বড় একটা নম্বর দেয় না বলে, প্রথমটাই সে বেছে নেয়। মেয়েটাকে শান্ত রাখতে গান শোনায়। মেয়েটাকে দেখেও মনে হয় না, চিঠির ডিক্টেশন নিতে নিতে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়বে।
বুয়েনস আইরেস নিজের (এবং লোকটার) ক্ষেত্রে সচেতন হ্যালুসিনেশনের বিলাসিতাকে পাত্তা দেয় না। আমরা, যারা লোকটাকে খানিক ক্ষণ ধরে দেখছি, তারা অন্তত জানি, তার ভয়ের মধ্যে কোনও বিভ্রম নেই। লোকটাকে আমরা পছন্দ না করলেও, নিজেকে শুধরে নেওয়ার সুযোগ তাকে দেওয়া যেতেই পারে। মেয়েটাও বিরাট কিছু নয়, আর সত্যি বলতে কী, চিতাটাই ওকে বাঁচায়, তবে এই ধরনের চিতা, যে শুধু দেখে যায় এবং কিছুই বলে না, একটা ঔদাসীন্য-ভর্তি লোকের ভেতরে থেকে কী-ই বা করবে? মেয়েটা অন্ধকারকে ভয় পেতে শুরু করে, শুধু চড়া আলো ভরা জায়গায় যায়, যাতে কেউ তার গোপন কথাটা জানতে না পারে। সে জেগে থাকলে চিতাটা চোখ খুলে রেখে ঘুমোয়, আর ঘুমোলে চিতাটা হয়তো জেগে থাকে, কিন্তু সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। চিতাটার কোনও খাবার লাগে না, এমনকী ভালবাসাও লাগে না। তার নাম এখন ‘পেপিতা’। বস এখন মেয়েটাকে পছন্দের চোখেই দেখে, কিন্তু কখনওই তার চোখের দিকে তাকায় না। উজ্জ্বল দিনের আলোয় বিছানার পরিবর্তে তারা অফিস-কার্পেটকেই বেছে নিয়েছে। তাদের সম্পর্ক দিব্যি চলতে থাকে। |
শেষে এমন কিছু হতেই পারে
• বছরে এক দিন পেপিতা ঈর্ষায় জ্বলে ওঠে। বসের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও মেয়েটার একটি চোখ বাঁচানো যায় না।
•
মেয়েটা শেষমেশ বসকে জানলা দিয়ে বাইরে ঠেলে ফেলে দেয় সেই প্রবচনটার কারণে: চোখই আত্মার জানলা, আবার উলটোটাও বটে।
•
পেপিতা চোখ থেকে লিভারে গিয়ে আস্তানা গাড়ে। মেয়েটা সিরোসিস-এ মারা যায়।
•
বস ও মেয়েটা বিয়ে করবে বলে ঠিক করে। ইলেকট্রিসিটির বিল হু হু করে বেড়ে চলে। কারণ ওরা কেউই আলো ছাড়া শোওয়ার সাহস পেত না।
•
পেপিতা বসের সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার শুরু করে। বাধ্য হয়ে মেয়েটা বসকে ছেড়ে চলে যায় বন্য জন্তুদের এক ট্রেনারের সঙ্গে, যে তাকে অত্যাচার করে।
•
পালিয়ে যায়, এক চোখের ডাক্তারের সঙ্গে, যিনি কথা দেন মেয়েটাকে অপারেশন করে সারিয়ে তুলবেন।
•
পালিয়ে যায়, পশু-চিকিৎসকের সঙ্গে। কারণ, পেপিতা অসুস্থ হয়ে পড়ায় মেয়েটা ভয় পায়, প্যান্থার মারা গেলে সে তার দৃষ্টিশক্তি খুইয়ে ফেলবে।
•
মেয়েটা রোজ দামি আই-ওয়াশ দিয়ে চোখ ধোয়। এখন সে ফুর্তিতেই আছে। কারণ, পেপিতা বৌদ্ধ বনে গিয়ে অহিংসার রাস্তা বেছে নিয়েছে।
•
মেয়েটা কাগজে পড়ে, আমেরিকায় কালো প্যান্থারের মোকাবিলায় নতুন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আশায় বুক বেঁধে সেখানে গিয়ে দেখে, ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। |
অনুবাদ সুস্নাত চৌধুরী
(সংক্ষেপিত) |
|
|
|
|
|