অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। জাম আর জামরুলের পাতায় যে রোদ্দুর নাকি লেগে থাকে অল্প একটু হাসির মতন। ওকে অমন শান্ত ভাবে চলে যেতে দেখে সে কথাটাই মনে পড়ছিল। আর তার পরেই কাট টু। শেষ দেখা দেখার জন্য নন্দনের দরজায় সাধারণ মানুষের ‘বিপুল তরঙ্গ’ দেখে বার বার মনে হতে লাগল, ওর এই একাকী নিঃসঙ্গ মৃত্যু কি তা হলে ওর ছবির মতো ওকেও, ওর বেঁচে থাকাকেও পুরোপুরি ভাবে, ঠিক যেমন ভাবে ও পরিপূর্ণ রূপে ‘নারী’ বা ‘পুরুষ’ হওয়ার পরিচিত ছক ভেঙে নিজের মতো করে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল তাকেও যথোপযুক্ত সম্মান দিতে শিখল?
না কি এ কেবল এক সেলেব্রিটি চিত্রপরিচালকের জন্য আমাদের তাৎক্ষণিক নাটুকেপনা, যার আসলে দীর্ঘস্থায়ী কোনও দাম নেই, কোনও প্রভাব নেই? ওকে শ্রদ্ধা জানাবার পরের দিনই পাড়ার ছেলেলি মেয়ে বা মেয়েলি ছেলে বা সমকামী নারীপুরুষদের আওয়াজ দিতে, বিরক্ত করতে, এমনকী সুযোগ পেলে হালকা ভায়োলেন্স করতেও তারা পিছপা হবে না, যারা আজ নন্দনে লাইন দিয়ে ওকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে? এই লম্বা লাইনে দাঁড়ানো লোকটিই আবার নিজের বাড়ির খোকাটির স্কুলে কোনও ‘মেয়েলি ছেলে’ থাকলে তাকে স্পষ্ট বলে দেবে, ‘ওর সাথে মিশবে না, ও ঠিক ইয়ে, মানে ঠিক নরমাল নয়!’ |
তা হলে নরমাল আসলে কতটা নরমাল? ছেলে মানে কী আর মেয়ে মানেই বা আসলে কী? কী কী তথাকথিত গুণ থাকলে একটা ছেলে ‘নরমাল’ ছেলে হয়ে ওঠে এবং একটি মেয়ে একেবারে আগমার্কা খাঁটি মেয়ে হয়ে ওঠে, আর না থাকলেই তারা হাস্যকর, প্রহসনযোগ্য হয়? বায়োলজিকাল সেক্স বা জৈবিক লিঙ্গ আর জেন্ডার বা সামাজিক লিঙ্গ কি তা হলে এক? মানে শরীরে নারী-চিহ্ন নিয়ে জন্মালেই তাকে মেয়েদের মতো হয়ে উঠতে হবে আর পুরুষচিহ্ন নিয়ে জন্মালে টিপিকাল পুরুষ হতে হবে— এই মূলস্রোত ধারণার বাইরে আমরা কোনও দিনই যেতে পারব না?
কে জানে, হয়তো পারব না। আর পারব না বলেই ছেলেলি মেয়ে, মেয়েলি ছেলে, ‘টমবয়িশ’ মেয়ে, আর কাজল-পরা ছেলেদের প্রতি আমাদের ভায়োলেন্স কোনও দিনই কমবে না। ঋতুপর্ণর প্রতিভা ছিল আকাশছোঁয়া আর ছিল লড়াই করার ক্ষমতা। তাই টিপিকাল নারীপুরুষের ছক-বাঁধা আরোপিত জীবনকে হারিয়ে তিনি নিজের মতো ছকহীন জীবন, অত্যন্ত কঠিন হলেও, যাপন করতে পেরেছেন, যত দিন থেকেছেন। আর এই ছক ভেঙে বাঁচতে চাওয়ার সাহস দেখানোর পুরস্কার যে তীব্র এলিয়েনেশন বা বিচ্ছিন্নতা, আর অপূর্ব এক আলোআঁধারির নিঃসঙ্গতা, যে কোনও ছক ভাঙতে চাওয়া মানুষই তা বিলক্ষণ জানেন!
আমরা একালে যাঁদের গালভরা নাম দিয়েছি এলজিবিটি (লেসবিয়ান গে বাইসেকশুয়াল ট্রান্সজেন্ডার) কমিউনিটি তাঁদের অনেকেরই এই সাহস এই প্রতিভা হয়তো নেই। কিন্তু এই অকালমৃত্যু যদি তাঁদের প্রতি আমাদের একটু সহনশীল করে তা হলে হয়তো নন্দনে লাইনে দাঁড়ানোর চেয়ে সেটাই আমাদের বেশি শ্রদ্ধার্ঘ্য হবে। পরিচালক ঋতুপর্ণ হয়তো জীবনের শেষ ক’টি ছবিতে সব থেকে বেশি করে সেটাই করতে চেয়েছিলেন।
একটা গোড়ার কথা মনে রাখা ভাল। সেক্স অর্থাৎ লিঙ্গ-চিহ্ন, যা নিয়ে আমরা জন্মেছি, আর জেন্ডার বা সামাজিক-ভাবে নির্মিত লিঙ্গ, দুটো ব্যাপার কিন্তু এক না। জৈবিক ভাবে পুরুষ বা নারীর আচার-আচরণ, স্বভাব-ব্যবহার, এগুলো অনেকখানি তাঁর সমাজ, পরিপার্শ্ব, পরিবেশের উপর নির্ভর করে, আবার তাঁর আচরণকে পুরুষ বা নারীর ‘স্বাভাবিক’ আচরণের যে মাপকাঠিতে বিচার করা হবে, সেই মাপকাঠিটাও অনেকাংশে সমাজ-নির্ধারিত। এবং একটি মানুষের জেন্ডার প্রকৃতিদত্ত নয়, সামাজিক ভাবে নির্মিত বলেই কোন আচরণ ‘ছেলে ছেলে’ আর কোন আচরণ ‘মেয়ে মেয়ে’, তা স্থান ও কাল বিশেষে পালটে যেতে পারে। যেমন আদিবাসী সমাজে মেয়েলি ভাব বলতে যা বোঝাবে, আর আমাদের বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েলি ভাব বলতে যা বোঝাবে, দুটো কিন্তু এক নয়। কিংবা, এত দূরেও যেতে হবে না, মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের স্বাভাবিক মেয়ে আর সেই পরিবারে যিনি কাজের মাসি তাঁর বাড়ির স্বাভাবিক মেয়ে— দুই স্বাভাবিক-এর ধারণার মধ্যে বিরাট তফাত থাকতে পারে। আবার, সময়ের সঙ্গে সঙ্গেও পৌরুষ বা নারীত্বের ধারণা বদলায়, সেটা আমরা চোখের সামনে দেখছি।
কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, এই সামাজিক লিঙ্গ আর জৈবিক লিঙ্গের তফাতের সঙ্গে এলজিবিটি কমিউনিটির সম্পর্ক কী? সম্পর্ক একটাই। জেন্ডার ব্যাপারটা প্রাকৃতিক নয়, একটা সামাজিক নির্মাণ, এটা বুঝতে পারলে এ কথাটাও বুঝতে আমাদের সুবিধে হবে যে, জৈবিক অর্থে নারী বা পুরুষ হয়ে জন্মালেই এক জন মানুষের আচার-আচরণ, স্বভাব-ব্যবহার, এমনকী তাঁর যৌনতার প্রকাশভঙ্গি সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী না-ই চলতে পারে। ছেলে-শরীর নিয়ে জন্মে এক জন মানুষ মেয়েলি হলে, চোখে কাজল পরলে, কথায় কথায় ‘মেয়েদের মতো’ চোখ ছলছল করলে, এমনকী আর একটি পুরুষকে কামনা করলেও হয়তো আপনার তাঁকে এতটা অস্বাভাবিক না-ও লাগতে পারে। কে জানে...
এ প্রসঙ্গে একটা স্বীকারোক্তি না করে পারছি না। ঋতুপর্ণ চলে যাওয়ার দিন মন খারাপ নিয়ে অঞ্জনদার (অঞ্জন দত্ত) বাড়িতে গেছি। আমাদের এক ডাক্তার বন্ধু কী একটা কথা বলতে গিয়ে বলছিল, ওর এক সহপাঠীর কথা। মেয়েলি হাবভাবের কারণে সেই সহপাঠীকে ক্লাসের বাকি ছেলেরা কতটা টিজ করত, সে সব কথা। বন্ধুদের টিজ করার ঠেলায় স্কুলের বাথরুমের ভিতর লুকিয়ে থাকত সে, আর কাঁদত।
হঠাৎই বুঝতে পারলাম, প্রায় বছর দশেক ধরে এলজিবিটি অধিকার রক্ষা ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা বলেও আসলে এই সব প্রান্তিক মানুষের কষ্ট, তাঁদের উপর ঘটে চলা ভায়োলেন্স, সমাজের কাছ থেকে তাঁদের একটুও সম্মান না পাওয়ার ইতিহাসের ধারা আসলে আমার, আমাদের অগোচরেই থেকে গেছে।
অন্য সহপাঠীদের মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা উকিল হতে চায়নি অমলকান্তি। ছক ভেঙে বেরোতে চেয়েছিল। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। তবুও এই লেখার মধ্যে দিয়ে ক্লান্ত বর্ষণ, কাক-ডাকা এক অমোঘ বিকেলে ছক ভেঙে বেঁচে থাকতে চাওয়া অমলকান্তিকে, অমলকান্তিদের সেলাম জানালাম। |