বিখ্যাত তথ্যচিত্রে দেখানো হইয়াছিল, কয়েকটি ইঁদুরকে অতি প্রশস্ত খাঁচায় রাখা হইয়াছে, একই প্রজাতির সমসংখ্যক ইঁদুরকে অতি সংকীর্ণ খাঁচায় রাখা হইয়াছে। কিছু দিনের মধ্যেই দেখা যাইল, প্রশস্ত খাঁচার ইঁদুরগুলি মহানন্দে খাইতেছে ঘুমাইতেছে, কেহ অন্যকে এতটুকু বিব্রত করিতেছে না। আর সরু খাঁচার ইঁদুরগুলি— যাহাদের হাঁটিতে গেলে গায়ে গা ঘষিয়া যায়, খাইতে গেলে একে ডিঙাইয়া তাহার পিঠে পা রাখিয়া পাত্রের নিকট পৌঁছাইতে হয়— হইয়া উঠিয়াছে অতীব মারকুটে, কলহপ্রবণ। ইহার পরেই ছবিটিতে দেখানো হয় একটি মার্কিন শহর, অট্টালিকা গিজগিজ করিতেছে, পথে মানুষ পিলপিল করিতেছে। মুহূর্তে এই প্রশ্ন উঠে: আমরা যদি এই ভৌগোলিক ভাবেই শ্বাসরোধকারী ঠাসাঠাসি শহুরে অস্তিত্বকে প্রাধান্য না দিয়া পল্লির প্রসারের মধ্যে বাঁচিয়া থাকাকে মর্যাদা দিতাম, তবে কি এমন হিংসুক যুদ্ধবাজ হীনচেতা হইতাম? ব্যস্ত বৃহৎ শহর-জীবনের সমীকরণ স্বতন্ত্র ও জটিল। তাহার দৃশ্য ও ধ্বনির চালচিত্র বহুলাংশে প্রকৃতিবর্জিত, কৃত্রিমতাশ্লিষ্ট। কিন্তু এই নগর-বিশেষত্বগুলি কি মানুষের মধ্যে কেবলই কিছু তিক্ততা ও চাপের উদ্ভব ঘটায়, না নাগরিকের মস্তিষ্ক ও স্বাস্থ্যকে নিরন্তর প্রবল ভাবে প্রভাবিত এবং পরিবর্তিত করিতে থাকে? এই লইয়া গবেষণা করিতেছেন ইংল্যান্ডের এক দল বৈজ্ঞানিক। |
ইহা আজ আলোচিত: দারিদ্র, একাকিত্ব, বা বর্ণবৈষম্যের পরিবেশে পর্যুদস্ত মানুষের মানসিক ও শারীরিক অসুখের সম্ভাবনা অধিক। এবং আমাদের সামাজিক আদানপ্রদানগুলি আমাদের স্নায়ু-স্থাপত্যকে ক্রমাগত বদলাইতেছে। নাগরিক জীবনও কি মানুষের স্নায়ুর উপর তাহার নিজস্ব হরফ উৎকীর্ণ করিতেছে? তাহার দ্বারা কি মানুষটির ব্যবহার ও প্রতিক্রিয়া এমন মাত্রায় নির্ধারিত হইতেছে, যাহা তাহার ‘স্ব’ভাব বদলাইয়া দিতে সক্ষম, এমনকী শরীর-ধরনটিকেও নিয়ন্ত্রণ করিতে পটু?
বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞের আয়ত্ত, তবু সহজ বুদ্ধিতেও এই গবেষণার উপসংহার ও তাহার কিছু ঋণাত্মক বিশ্লেষণ অনুমেয়। বাড়ির সংলগ্ন এলাকায় স্পিকার হইতে তারস্বরে গান শুনিতে শুনিতে নাগরিকের প্রসন্নতা বাষ্পীভূত, প্রতি দিন অফিস যাইবার পথে অসহ্য যানজটে ও ভিড়ের নারকীয় নিষ্পেষণে তাহার কার্যদক্ষতা ক্ষীয়মাণ। বারান্দায় দাঁড়াইলে কেবল অন্য বাড়ির দেওয়াল দর্শন এবং জানালা খুলিলেই ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলি প্রতিবেশীর সম্মুখে উন্মোচন করিবার ক্ষোভ তাহার অম্বল ও রক্তচাপ বাড়াইতেছে। পথে বাস ও অটো তাহার ফুসফুসের উদ্দেশে চরম বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়িয়া যাইতেছে, তাহার শিশুটিও হাঁপানির দ্বারে উপনীত। অতি অবশ্য নগর তাহার প্রজাদের নিকট হইতে বিস্তর খাজনা লইতেছে। কিন্তু পল্লিজীবনের প্রতি দৃষ্টি ফিরাইলে দেখা যাইবে, সেখানেও কেবল অমৃত-আনন্দ বিরাজ করিতেছে না। জলে মশক নাচিতেছে, পুকুরে কচুরিপানা। মাটিতে বৃশ্চিক, বায়ুময় রোগ-জীবাণু। চতুর্দিকে প্রকট দারিদ্র, রাজনৈতিক হানাহানি। প্রভূত হীনম্মন্যতা। জীবন যাপনে তাড়াহুড়াহীন স্বস্তি কিছু দিনের মধ্যে শ্লথতা, স্থবিরতা, অবসাদ বলিয়া প্রতিভাত হইতে পারে। উচ্চাকাঙ্ক্ষার দ্রুতিকে ব্যঙ্গ সহজ, কিন্তু তাহা ত্যাগ করিয়া কেবলই বিস্বাদ অভ্যাসবৃত্তে আবর্তনও সকলের ক্ষেত্রে আহ্লাদবাহী নহে। মনে রাখিতে হইবে, বৈভবেরও সৌন্দর্য, মহিমা রহিয়াছে; নিরন্তর বিদ্যুৎ-জোগান, পরিচ্ছন্ন শৌচালয়, আবৃত নর্দমা, সু-চিকিৎসা-সুযোগের স্বাচ্ছন্দ্যও অতুলন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও সাম্প্রতিক সিনেমার নৈকট্য কম তৃপ্তিবাহী নহে। তাই গবেষণার চলন দেখিয়া ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’ রোদন কিঞ্চিৎ ‘গ্রাম্য’ হইয়া পড়িবে। |