‘বিরিয়ানি’ বাঙালি খানা, কিন্তু ‘দাওয়াত’ দেয় কে?
রেজালা, কাবাব, ফিরনি—শব্দগুলির অর্থ কে না জানে। কিন্তু ফুফা আর আপা, দাফন আর কাফনের পার্থক্য জানে ক’জন?
মুসলমান সমাজে প্রচলিত অনেক শব্দ প্রমিত বাংলায় ঠাঁই করে নিতে পারেনি। এমনকী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এ প্রজন্মের শিক্ষিত তরুণরাও নিজেদের ভাষায় কথা বলেন না। তেমন অনেক শব্দই বাংলা ভাষা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।
মুর্শিদাবাদের ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন খাজিম আহমেদ। তিনি বলেন, “বাংলা সাহিত্যে গ্রামীণ মুসলমান সমাজের প্রভাব কম। তাই ওই সমাজের ভাষাও নাগরিক বাংলা শব্দ ভান্ডারে প্রভাব ফেলতে পারেনি।” বাজার-চলতি বেশির ভাগ বাংলা অভিধানেও আরবি-ফার্সি শব্দ তেমন জায়গা করে নিতে পারেনি। নাস্তা-পানি (জল খাবার), দাওয়াত (নিমন্ত্রণ), গোস্ত বা গোস্ (মাংস), নেকি (পুণ্য), গুনা (পাপ), দোয়া (শুভ কামনা), বদ্দোয়া (অভিশাপ), গজব (আল্লার দণ্ড), রহম (প্রভুর করুণা), মেহমান (অতিথি), এতিম (অনাথ), দুনিয়াদারি (ইহকাল), মিসকিন (দীন-দরিদ্র)-এর মতো বহু শব্দ রয়েছে যা বহু বাঙালি মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য। কিন্তু এই শব্দগুলি অধিকাংশ বাংলাভাষী মানুষের অচেনা।
সম্প্রীতির চিত্র

২০১২-এ কলকাতা পুলিশ আয়োজিত অনুষ্ঠানে।—নিজস্ব চিত্র।
লোকসংস্কৃতিবিদ শেখ মকবুল ইসলাম বলেন, “সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত গ্রামীণ সমাজে কিছু শব্দের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। যেমন, ‘মুসলমানি’, ‘মাটি দেওয়া’ ‘রেহেল’, ‘নামাজ পাটি’-র মতো শব্দগুলি একান্তভাবেই মুসলমানের নিজস্ব সংস্কৃতি নির্ভর। তাই এই শব্দগুলি অ-মুসলমান বাঙালিরা স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবহার করেন না। কিন্তু নাস্তা, আদাবের মত শব্দগুলি জানলেও, এগুলি ব্যবহারে কেমন যেন একটা দ্বিধাবোধ করেন। বাঙালি মুসলমানের জীবনচর্চা মূল স্রোতের বাঙালি ধারার সঙ্গে মিশতে পারেনি। অন্য দিকে মোগলাই খানাপিনাতে অভ্যস্ত সকলেই। তাই রেজালা, কাবাব, ফিরনির মানে সকলেই বোঝেন।”
ভাষাতত্ত্বে বলা হয়, যে কোনও ভাষায় কোনও শব্দের যত বেশি সমার্থক শব্দ বা প্রতিশব্দ হয়, ভাষার পক্ষে তত ভাল। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় আরবি-ফার্সি শব্দের অন্তর্ভুক্তি ছিল চোখে পড়ার মত। সেই সময়ে ভিনদেশি শব্দ -- আদালত, দায়রা, ফৌজদারি, দেওয়ানি - কত সহজে প্রমিত বাংলায় স্থান করে নিয়েছে। হয়তো তার কারণ, সেই সময় এ দেশে শাসকের ভাষা ছিল ফার্সি। কোর্ট-কাছারিতেও ব্যবহৃত হত সেই ভাষা। পরে শাসকের বদল হলেও বাংলা ভাষা আত্তীকরণ করে নিয়েছে বিদেশি শব্দগুলিকে।
কিন্তু নতুন করে বাংলায় আরবি-ফার্সি শব্দগুলির অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে না কেন? বিশেষজ্ঞরা কিছু কারণ তুলে ধরছেন। প্রান্তিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাক্ষরতার হার উল্লেখযোগ্য হারে কম। তাই তাঁদের কথ্য মূল স্রোতের বাংলা ভাষাতে ঠাঁই পায় না। আবার বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যে খুব কম চরিত্রই উঠে আসে ওই সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে। সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ, সৈয়দ মুজতবা আলি, সৈয়দ মুজতবা সিরাজ, আবুল বাশার ও আনসার উদ্দিনের মতো জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের কলমে কিছু গ্রাম্য মুসলিম চরিত্র উঠে এসেছে। সৈয়দ মুজতবা আলির ‘শবনম’ বা আবুল বাশারের ‘রাজিয়া’ চরিত্র পাঠকের কাছে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু সেই চরিত্রগুলির মুখের বুলি, কিংবা উপন্যাসের ভাষা ব্যবহারে অভ্যস্ত নন আম বাঙালি। যে কোনও দেশে-কালে সংখ্যালঘুদের খোলসের আবরণে নিজেকে বন্দি করে রাখে। তাই বৃহত্তর সমাজে মেলামেশার সময় সংখ্যালঘু নিজের ভাষায় কথা বলে না। এমনকী নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাতেই মূলস্রোতের ভাষাই ব্যবহার করেন বাঙালি মুসলমান। অধ্যাপিকা মিরাতুন নাহার বলেন, “আজকাল শহুরে মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে মেলামেশার ক্ষেত্রেও ‘পানি’-র পরিবর্তে ‘জল’, ‘খালা’-র বদলে ‘মাসি’ বলাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।”
তাহলে কি গ্রামীণ মুসলমানের মুখের ভাষা হারিয়ে যাওয়াই ভবিতব্য? সাহিত্যিক জাহিরুল হাসান বলেন, “এই মুহূর্তে প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিকের সংখ্যা হাতেগোনা। তাই বাংলা সাহিত্যে সাধারণ মুসলিমের কথাও উঠে আসছে না। আবার আর্থ-সামাজিক বিভাজনের দরুণ উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে হৃদ্যতা তৈরি হয়নি। তাই মূলস্রোতের বাঙালি সাহিত্যিকের কলমে ফুটে উঠছে না গ্রামীণ মুসলিমের ভাষা।” তবে তিনি আশাবাদী, তাই এও বলেন, “ভাষা তার টিকে থাকার তাগিদেই অন্য ভাষা থেকে শব্দ ধার করে। প্রয়োজনের তাগিদেই বাংলা ভাষাও একদিন প্রতিবেশী মুসলিম সম্প্রদায়ের মুখের ভাষা ধার করবে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.