সবে ডাল মাখা ভাতটা শেষ করে মাংসটা ধরবেন। ধাঁই করে একটা আধলা ইট উড়ে এসে পড়ল বেতবেড়িয়ার এক তৃণমূল কর্মীর পাতে। তাঁর পাশেই বসেছিলেন ওই গ্রামের আর এক তৃণমূলকর্মী। তিনি তত ক্ষণে মাংস শেষ করে রসগোল্লায় হাত দিয়েছেন। আর একটা ইটের টুকরো পড়ল তাঁর পাতেও। খাওয়া মাটি। তবে কাল বিলম্ব না করে সেই ইটই তুলে উল্টো দিকে ছুড়ে দিলেন তাঁরা। তাতে গুরুতর চোট লেগেছে হাতিশালা গ্রামের দুই তৃণমূল কর্মীর।
মুহূর্তের মধ্যে নদিয়ার চাপড়ার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ভাতের হোটেলই বদলে গেল রণক্ষেত্রে। এঁটো হাতেই শুরু হয়ে গেল হাতাহাতি। মারামারি। গ্লাস, থালা, মাংসের হাড় ছোড়াছুড়িও শুরু হয়ে গেল রাতারাতি। তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কারা আগে খেতে বসবেন, তাই নিয়ে ওই বিবাদে জখম হয়েছেন তাঁদেরই বেশ কয়েকজন কর্মী। দলের ঝাণ্ডা দিয়েই একে অপরকে পিটিয়েছেন তৃণমূল কর্মীরা।
শুক্রবার এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রাম থেকে তৃণমূল কর্মীরা দল বেঁধে এসেছিলেন পঞ্চায়েত ভোটে তাঁদের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে। সকাল থেকেই গমগম করছিল চাপড়া ব্লক অফিসের সামনের চত্বর। তৃণমূল কর্মীদের দুপুরের খাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ছিল স্থানীয় একটি হোটেল। মেনু ছিল, ডাল, ভাত, তরকারি, মাংস বা মাছ এবং চারটি করে রসগোল্লা ও দই। তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁদের দলের বেতবেড়িয়ার কর্মীরা আগে মনোনয়ন জমা দিয়ে খেতে বসে যান। কিছু ক্ষণের মধ্যেই মনোনয়ন জমা দিয়ে সেখানে হাজির হন হাতিশালার কর্মীরা। তাঁদের দাবি ছিল, তাঁরা আগে খাবার দেওয়ার কথা বলে গিয়েছিলেন। তবু তাঁদের বদলে কেন বেতবেড়িয়ার কর্মীদের খেতে দিয়ে দেওয়া হল? বেতবেড়িয়ার তৃণমূল কর্মীদের অবশ্য দাবি, তাঁরা টেবিল ফাঁকা দেখেই খেতে বসে গিয়েছিলেন। হাতিশালার কর্মীরাই তাঁদের দিকে ইট ছুড়তে শুরু করে। তখনই গণ্ডগোল বেঁধে যায়। |
ওই হোটেলের এক কর্মীর কথায়, “দুই দলই মারমুখী ছিল। কাকে ছেড়ে কার কথা শুনব?” চাপড়া ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের বিদায়ী প্রধান কংগ্রেসের দিন মহম্মদ বিশ্বাস বলেন, “বাজার ভর্তি লোকের সামনে নিজেদের রূপ প্রকাশ করে ফেলল তৃণমূল।” সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক সামসুল ইসলাম মোল্লার বক্তব্য, “আগে খেতে দিতে হবে, এই দাবি নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের দৃশ্য দেখেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।”
চাপড়ার বিধায়ক তৃণমূলের রুকবানুর রহমান অবশ্য বিষয়টি ‘সামান্য’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “চারপাশ থেকে অনেক তৃণমূল কর্মী এসেছিলেন। দুপুরে খাওয়ার সময়ে তাঁদের মধ্যে সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে মাত্র।” কিন্তু একই ব্লকের দু’টি গ্রামের কর্মীদের মধ্যে এই ঘটনায় দলের শৃঙ্খলা কি বিঘ্নিত হল না? তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরী দত্তর জবাব, “বিয়ে বাড়িতে একই পরিবারের সদস্যেরাও আগে খেতে বসা নিয়ে হুড়োহুড়ি করেন। আমাদের দলও একটি পরিবার। এটা খুবই সামান্য ঘটনা।”
বোলপুরে কিন্তু তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামলাতে এ দিন র্যাফ, কমব্যাট ফোর্স ও বিশাল পুলিশ বাহিনীকে নামতে হয়। এমনিতেই এই জেলায় তৃণমূল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ। মনোনয়নপত্র পেশ নিয়ে তা আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। শুক্রবার থেকে বোলপুর ব্লক অফিস ছাড়াও মহকুমা শাসকের দফতরে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কাজ শুরু হয়। কিন্তু তাতেও ঝামেলা এড়ানো যায়নি।
তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধী গোষ্ঠীর লোকজনের দফায় দফায় বিবাদ হয়। দু’গোষ্ঠীর লোককে একে অপরকে তাড়া করতেও দেখা যায়। পুলিশ পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এলাকায় টহলদারি বাড়ানো হয়। জল কামানও নামাতে হয়েছে। কোচবিহারে দলের কর্মীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন তৃণমূলের জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষও। কারও দাবি ছিল মনোনয়ন জমা দিয়েছেন যে প্রার্থী, তাঁকে বাতিল করতে হবে। কারও দাবি নতুন প্রার্থীর নাম বলতে হবে। রবীন্দ্রনাথবাবু সব শোনার পরে পরিস্থিতি আয়ত্তে আসে। |