অঞ্জন-ব্যঞ্জন

এ ডিম আজি...
বাঙালির জীবনে ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র তর্কে ডিম সব সময়েই এগিয়ে। ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার, ডিম অবশ্যম্ভাবী, অনস্বীকার্য। আর ডিম মানে যে শুধুই মুরগি বা হাঁসের তা কিন্তু নয়, মাছের ডিমও কিন্তু বাঙালির পাতে রীতিমতো কদর পেয়ে থাকে। ডিম কী ভাবে আমার ও আমাদের জীবনকে কন্ট্রোল করে আজ তাই একটু তলিয়ে দেখা যাক।
ডিম নিয়ে আমার অনেক ড্রিম। এগরোল থেকে কবিরাজি। মোগলাই পরোটা থেকে অমলেট। ডিমের ডালনা থাকে ভুজিয়া। কোথায় নেই এই মনমোহন ডিম্ব, যার সমস্ত লোভনীয় রেসিপি আজকাল আর প্লেটে নয়, আমার স্বপ্নে আসে। কারণ, আমার জীবনটা এখন এগলেস। কোলেস্টেরল নামক ঘাতক বস্তুটি যাতে শরীরে গেঁড়ে বসতে না পারে, তাই ডাক্তারবাবুর হুকুম। অমান্য করব এমন পুরুষসিংহ আমি নই, স্ত্রীর কড়া নজর বাঁচিয়ে তার পর বাঁচব ভেবেছেন? তাই ডিম নিয়ে প্রেম নয়, বিরহের কথা বলে আসুন আজকের আড্ডা শুরু করি।
এখনও মনে আছে আমাদের শ্যামপুকুরের বাড়ির পুবদিকের জানলা বেয়ে যখন সূর্য উঠত, পাড়ার মাখনদা’র চায়ের দোকানে ঠিক তার পরে পরেই তেমনই অরেঞ্জ কুসুম সমেত ভেসে উঠত দিনের প্রথম পোচ, যার ম-ম করা গন্ধে আসছে পরীক্ষার টেনশন কোথায় হাওয়া! খাদ্যবস্তুর লোভ সংবরণ করার অগ্নিপরীক্ষায় আমি চিরদিনই ডাহা ফেল, সে দিনও তার নড়চড় হয়নি, পড়ার ঘর থেকে সোজা মাখনদা’র কাঠের বেঞ্চিতে। অবশ্য এ জন্য বাড়িতে দিদিদের কাছে কম কানমলা খাইনি। আর গ্রে স্ট্রিট মোড়ের মিত্র কাফে-র সেই বিখ্যাত ডিমের ডেভিল যেন মিনি গ্রেনেড। অমন নিঃশব্দ বিস্ফোরণ খুব কম অস্ত্রেই সম্ভব। পুরু টোস্ট বিস্কুটের আবরণ ভেদ করে যখন তার প্রাণকেন্দ্রে কেউ প্রবেশ করত, আজও স্পষ্ট মনে পড়ে আনন্দে আবেগে আমার মতো আরও অনেক ডিম-ড্রিমারদের চোখেই জল চলে এসেছে। সে দিনও, আজও!
তবু, কারও কাছে যেমন হুঁশিয়ারি, কারও কাছে তেমনই ওয়েলকাম ডায়েট এই ডিম। খেলোয়াড়দের তো মাস্ট, অন্য নানা রকম শরীরচর্চাকারীর কাছেও ডিম এক সুস্বাস্থ্যের বার্তা। ডিমের সাদা অংশটি তো রীতিমতো পুষ্টিকর, কুসুম ঠিক ততটাই নয়। কিন্তু কে বোঝাবে ডাক্তারবদ্যিদের, যত স্বাদ ওই নিষিদ্ধ কুসুমিত গোলকটিতেই। স্বাদ আর স্বাস্থ্যের এই বিবাদ তো বহু দিনের। যেটা খেতে ভাল লাগে, সেটা খাওয়া ভাল না। কোন দিকে যাবেন?
যে দিকেই যাস, যাত্রার আগে খবরদার ডিম দেখিস না আমার বুড়ি পিসিমার সাবধানবাণী ছিল বাড়ির সবার জন্য। ডিমভক্ত হওয়ার সুবাদে সেই ফতোয়া মানিনি কখনও, তবে নিজের চোখে হস্টেলের এক বন্ধুকে দেখেছি, পরীক্ষার দিন ডাইনিং হলে ডিমের মুখদর্শন করে বেসিনে গিয়ে চোখমুখ ধুয়ে আসতে। ডিম নিয়ে এমন অ-দেখলাপনা দেখলে সে দিনও হাড়পিত্তি জ্বলে যেত, আজও যায়!
মাঝে মাঝে আমার এই অতিরিক্ত ডিমপ্রীতির কারণে, আমার বন্ধুরা আমাকে ‘অঞ্জন আন্ডা-র কন্ট্রোল-এ’ বলে খ্যাপায়। কিন্তু সব আওয়াজ কি গায়ে মাখলে চলে? তার চেয়ে বরং ডিমের একটা পুরনো গল্প বলে আজকের মতো শেষ করি। সেই যে একটা ঘোড়া ছিল, যার মালিক খুব আশা করে ছিল, এক দিন না এক দিন ঘোড়াটা ডিম পাড়বে। কিন্তু ওর মন ভেঙে গেল সে দিন, যে দিন সে জানতে পারল ওটা আসলে একটা গাধা। হলফ করে বলতে পারি, ডিমের ব্যাপারে এই লোকটি আমার চেয়েও একটু বেশি অবসেসড ছিল!
ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.