ব্যাগ গুছিয়ে... ভূস্বর্গের বাগিচায়
রফ-বৃষ্টির মজাটা ষোলো আনা উপভোগ করলেও আবহাওয়াটা কিন্তু বেশ খানিকটা ভোগাল। আরু ভ্যালি যাওয়ার প্ল্যানটা ভেস্তেই গেল। কী আর করা? অগত্যা পহেলগাঁও থেকে ফিরে চলা শ্রীনগরের দিকে। বেলা বাড়ছে, আকাশটাও ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। পুরো শ্রীনগরটাই তো ঘোরা বাকি! পহেলগাঁও যাওয়ার আগে হাতে সময় বিশেষ ছিল না। শ্রীনগরে পৌঁছে তাই ডাল লেকের ধার ঘেঁষে সোজা চলে গেলাম ‘গুল লালা’য়। কাশ্মীরিতে গুল লালা, আসলে সেটা টিউলিপের বাগান। আর সেটা তো ভরা মরসুম। লাল-হলুদ-বেগুনি-কমলা-সাদা আরও কত বিচিত্র রঙের গালিচা পাতা যেন সামনে। থরে থরে সাজানো টিউলিপের সমারোহ নিয়ে সে এক বর্ণিল উদ্যাপন! দৃষ্টিপট থেকে সে রং সহজে মোছার নয়।
টিউলিপের রং চোখে মেখেই ঘুরে নিলাম শালিমার গার্ডেন, নিশাত গার্ডেন, পরী মহল, চশমে শাহি আর বটানিক্যাল গার্ডেন। শালিমার ও নিশাত মুঘল আমলে তৈরি। সবুজ চিনার গাছে ঘেরা, রকমারি ফুল আর ঝরনায় নিখুঁত সাজানো নিশাত আর শালিমার সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। জবরবন রেঞ্জের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা পরী মহল থেকে তো গোটা শ্রীনগরটাই ধরা পড়ে চোখের সামনে ডাল লেক-সহ। আর আছে পাহাড়ের মাথায় শঙ্করাচার্য মন্দির। ফোর্টের কাছে আছে আমন্ড গার্ডেনও। সে সব জায়গায় কথা বলে ইতিহাস। শ্রীনগরের এ মাথা থেকে ও মাথা চক্কর কেটেই তাই কেটে গেল গোটা দিনটা।
ধীরে ধীরে বিকেল হল। সূর্যের তেজ কিছুটা কমেছে। এ বার তবে যাওয়া যাক ডাল লেক সফরে। অবশ্যই শিকারায় চড়ে। ডাল লেকের ধার ঘেঁষে ছুটছে ব্যস্ত শহরটা। সারি সারি হোটেল, দোকানপাট। তারই মাঝে ডাল লেকের পাড়ে একটার পর একটা ঘাট। সেখানেই সাদা ফিনফিনে পর্দা দেওয়া, সাদা রঙের শিকারা আমাদের। সব ক’টারই একটা নাম রয়েছে। আমাদেরটার নাম ‘সো লেট্স গো’! ডাল লেকের এক ধারে সারি সারি শিকারা রংবেরঙের, পর্যটকদের অপেক্ষায় রয়েছে ভেড়ানো। মনে পড়ে যাচ্ছে ‘কাশ্মীর কি কলি’র কথা। অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে সারে সারে হাউসবোট। তার একটাতেই আমরা রাত কাটাবো। তার আগে ঘুরে নেবো ডাল লেকের এ দিক-সে দিক।
ফুরফুরে হিমেল হাওয়া মেখে শুরু হল শিকারা-বিলাস। সে এক মেজাজি অভিজ্ঞতা। লঘু গতিতে কিছুটা দূর এগোতেই কাশ্মীরি গয়না বিকিকিনি করতে আর এক শিকারা এসে লাগল ‘সো লেট্স গো’-র গায়ে। এখানকার এটাই দস্তুর। শিকারা-সফরের সঙ্গে দিব্যি চলে ব্যবসা-বাণিজ্যও। কখনও গয়নাগাঁটি, কখনও খাবার-দাবার, ফুল কিংবা শুকনো ফলের ব্যাপারীরা শিকারা নিয়ে এক্কেবারে কাছে চলে আসে। শুরু হয় দরদাম।
টুকটাক কেনাকাটি সেরে তরতরিয়ে জল কেটে এগোতে থাকে আমাদের শিকারা। মাঝে মাঝেই সঙ্গী হয় অন্য শিকারার দল। ওই তো দেখা যায় ‘চার চিনারি’। চারটে চিনার গাছ ঘিরে তৈরি একটা ছোট পার্কের মতো। শিকারা-সফরের মাঝে অনেকেই ওখানটায় নেমে একটু জিরিয়ে নেয়। আবারও এগোতে থাকি। শিকারার গদিতে বসেই ছুঁয়ে নেওয়া যায় ডাল লেকের জল। জলের নীচে দেখা যায় লতানে গাছপালা। মাঝে মাঝে মুখ তোলে নাম-না-জানা পাখি আর হাঁস। আরও ভিতরে ঢুকতে থাকি ডালের। তবে সেখানটায় ডাল লেক প্রায় এক বদ্ধ জলাশয়। জলজ গাছে ভর্তি। কোথাও কোথাও অনেক মানুষেরও বাস। চোখে পড়ে, সারা দিনের কাজ মিটিয়ে বা বৈকালিক দোকানপাট সেরে ডিঙি নৌকায় বাড়ি ফিরছেন কাশ্মীরিরা। কোথাও এক বৃদ্ধা ডিঙিতে রাশি রাশি শাক তুলে ফিরছেন। মধ্যবয়স্কা এক জন ডিঙিতে তুলেছেন জ্বালানি কাঠের বান্ডিল। শিকারা আরও এগোতে থাকে।
এ বার পৌঁছে গিয়েছি ‘ফ্লোটিং মার্কেট’-এ। পুরোটাই জলের ওপরে। কিন্তু আকারে নেহাত ছোট নয়। সেখানে কী নেই! হস্তশিল্পের দোকান থেকে শুরু করে দর্জির দোকান, খাবারের দোকান থেকে শুরু করে জামাকাপড়ের দোকান। মায় ইলেকট্রনিক্স জিনিসের দোকান পর্যন্ত। শিকারায় চড়েই সে সব দোকানে আসছেন ক্রেতারা।
ভাসমান দোকান থেকে চলছে বিদেশি পর্যটকদের ডাকাডাকি। দু’দিকে সার সার দোকানের মাঝখান দিয়ে একের পরে এক শিকারা চলেছে ধীরে সুস্থে। সব মিলিয়ে জমজমাট ভাসমান বাজার। দোকানপাটগুলোকে পিছনে ফেলে আর একটু এগোতেই হাউসবোটের ভিড়। তাদেরও সব নানা রকম নাম। আমরা যাব ‘গুলফাম’-এ।
শিকারায় চড়েই পৌঁছনো গেল রাজকীয় এক নৌকাবাড়িতে। পাশাপাশি সব ক’টা হাউসবোটই বেশ চোখজুড়োনো। আমাদের ‘গুলফাম’-এর ম্যানেজার বিলাল জানাল, এই গুলফামেই নাকি এক সময়ের দূরদর্শনের জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘গুল গুলশন গুলফাম’-এর শু্যটিং হয়েছিল। গুলফামের বারান্দায় বসেই সময় কেটে যায় নিমেষে। সামনে ডাল লেকে শিকারার অবিরাম যাতায়াত। ডিঙি নৌকায় চড়ে ব্যাপারীরা হাঁক দিয়ে যায়, ‘কুছ চাহিয়ে সাহাবজি-বহিনজি?’ আর ও পারে ব্যস্ত শহর। বিকেলের আলো ম্লান হয়ে আসা সদ্য সন্ধেবেলায় দূরের আলোগুলো জলে পড়ে চিকচিক করে। বারান্দা ছেড়ে ভেতরে ঢুকতেই গুলফামের বিলাসবহুল লবি। আরও ভিতরে সার সার ঘর। আধুনিক স্বাচ্ছন্দ্যের সব সরঞ্জামই মজুত।
ধীরে ধীরে রাত হয়ে আসে। টুপ করে আঁধার নামে। নৌকাবাড়ির বারান্দায় বসে পাহাড়ে ঘেরা শ্রীনগর শহরটাকে দেখতে দেখতে রাত আরও গাঢ় হয়। বিলাল বলছিল, আল্লার দোয়ায় এখন আবার মোটামুটি সব ঠিক চলছে। ভূস্বর্গে আবারও পর্যটক আসছেন। ব্যবসাপত্তরে একটু স্বস্তির মুখ দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচছেন কাশ্মীরিরা। মনও তাই বলছে, এই যে নিঝুম রাত্তিরের নীলচে ডাল লেক। আশপাশের হাউসবোট থেকে ভেসে আসা টুকরো টুকরো শব্দবন্ধ ছাড়া আরও কিচ্ছুটি নেই কোথাও। এই শান্তিটা ঠিক তেমনই আছে, বদলায়নি একটুও। ঠিক যেমন বদলায়নি রূপসী কাশ্মীরের অতুল ঐশ্বর্য।

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে জম্মু হয়ে পৌঁছনো যায় শ্রীনগর। সরাসরি বিমানেও যাওয়া যেতে পারে।
কখন যাবেন
ঘোর বর্ষা ছাড়া সব সময়েই যেতে পারেন। তবে শীতকালে খুবই ঠাণ্ডা পড়ে। এপ্রিল
মাসে গেলে দেখতে পাবেন টিউলিপ। আপেলের সময় আর একটু পরে।
কোথায় থাকবেন
শ্রীনগরে নানা দামের অনেক হোটেল আছে। থাকতে পারেন হাউসবোটেও।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.