মন্ত্রীদের মাইনে বাড়ানো দরকার। তাই বাড়াতে হবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেতনও।
যদিও মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসা ইস্তক মমতা নিজের প্রাপ্য বেতন নেননি। অর্থ দফতর প্রতি মাসে নিয়ম করে তাঁর নামে মাইনের চেক বানায়। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তা পাঠানোও হয়। এবং প্রতি বারই নিয়ম করে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
গত দু’বছর ধরে এমনই চলে আসছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বেতন না-নিলেও এ বার নিয়মের খাতিরে তাঁর বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব করতে বাধ্য হচ্ছে স্বরাষ্ট্র দফতর। কারণ, মুখ্যমন্ত্রীর বেতন না-বাড়ালে অন্য মন্ত্রীদের বেতনবৃদ্ধিও সম্ভব নয়। মন্ত্রীদের বাড়তি টাকা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে কেন?
সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা: রাজ্যে পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ আসার পরে সরকারি কর্মীদের বেতন-ভাতা বেড়েছে। বিধায়কদের মাইনেও বেড়েছে। শুধু মন্ত্রীরা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই রয়েছেন। তাই এ বার মুখ্যমন্ত্রী-সহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের বেতন বাড়ানোর পক্ষপাতী সরকার। স্বরাষ্ট্র দফতরের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবটি কার্যকর করতে হলে অবশ্য তাতে শেষমেশ মুখ্যমন্ত্রীরই সিলমোহর চাই। মহাকরণের এক কর্তার কথায়, “শীর্ষস্তরের সম্মতিক্রমেই আমরা মন্ত্রী-বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব তৈরি করছি। এর পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মুখ্যমন্ত্রী।” |
মন্ত্রীদের বেতনবৃদ্ধির সম্ভাবনায় সরকারি কর্মীমহলের একাংশে আবার কিছুটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মহাকরণের কর্মচারীদের অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে সরকারের মুখে নিত্যদিন অর্থসঙ্কটের কথা, যেখানে সাধারণ কর্মীদের নানা পাওনাগন্ডা আটকে, সেখানে মন্ত্রীদের বেতন বাড়ানোর এত তাগিদ কেন? কো-অর্ডিনেশন কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক মনোজকান্তি গুহের অভিযোগ, “কর্মীদের ২৮% ডিএ বকেয়া। জুলাইয়ে কেন্দ্র আরও ৭% ডিএ ঘোষণা করলে কেন্দ্র-রাজ্য মহার্ঘভাতার ফারাক দাঁড়াবে ৩৫%।” অর্থাৎ রাজ্যের কর্মচারীরা কার্যত এক-তৃতীয়াংশ পাওনায় বঞ্চিত হচ্ছেন বলে তাঁর দাবি। “এ অবস্থায় মন্ত্রীদের বেতনবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কেন?” প্রশ্ন মনোজবাবুর।
সরকারের কী বক্তব্য?
রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “মন্ত্রীদের বেতন সব চেয়ে কম পশ্চিমবঙ্গে। আমরা বিধায়কও। অথচ মন্ত্রী হয়ে গিয়েছি বলে বিধায়কদের মতো বেতন-পেনশন পাই না। পঞ্চম বেতন কমিশনের পরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা যে মাইনেকড়ি পান, মন্ত্রীরা তার চেয়ে কম টাকায় মন্ত্রিত্ব করেন।” সুব্রতবাবুর কথায়, “বিধায়কদের বেতনও বেড়েছে। বিরোধী কোনও বিধায়ক তা নেবেন না, এমন তো শুনিনি!”
রাজ্যের পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “মন্ত্রীদের বেতন বাড়ানোর দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র দফতরের। দফতর প্রস্তাব দিলে মুখ্যমন্ত্রী তা ভেবে দেখবেন। এটাই নিয়ম।”
কাজের বিনিময়ে কত পান মন্ত্রীরা?
সরকারি সূত্রের তথ্য: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এখন বেতন বাবদ মাসে পান সাড়ে আট হাজার টাকা। বিভিন্ন ভাতা মিলিয়ে মাস পয়লায় তাঁর প্রাপ্যের অঙ্কটা দাঁড়ায় সাড়ে আটত্রিশ হাজারের মতো। অন্যান্য মন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতার বেতন মাসে সাড়ে সাত হাজার, ভাতা ইত্যাদি জুড়ে মোট প্রায় সাড়ে সাঁইত্রিশ।
এ দিকে মমতা সরকার ক্ষমতায় আসার পরে, ২০১২-র ১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিধায়কদের বেতন বেড়ে হয়েছে মাসে বারো হাজার টাকা। সঙ্গে টেলিফোন-ইন্টারনেটের খরচ বাবদ পাঁচ হাজার, এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি কাজকর্মে বা স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠকে হাজির হলে দৈনিক হাজার টাকা ভাতা। “হিসেব কষে বিধানসভায় হাজিরা দিতে পারলে বেতন-ভাতা বাবদ মাসে মোটামুটি ৪৭ হাজার টাকা আসে।” বলেন শাসকদলের এক বিধায়ক। প্রশাসনের এক কর্তা জানান, বর্তমান সরকার বিধায়ক-প্রাপ্য বাড়ানোর সময়ে মন্ত্রীদেরও দৈনিক ভাতা চালু করেছে। এ বাবদ তাঁরা মাসে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেতে পারেন। কিন্তু মন্ত্রীদের বেতন বাড়ানো হয়নি। এখন তারই তোড়জোড় চলছে। কী রকম?
সরকারি সূত্রের খবর: মুখ্যমন্ত্রীর বেতন ১৪ হাজার ২০০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের সংবিধান শাখা। প্রস্তাবটি চূড়ান্ত মঞ্জুরি পেলে ভাতা সমেত তাঁর প্রাপ্য দাঁড়াবে সাড়ে চুয়াল্লিশ হাজারে। অন্যান্য মন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতার মাইনে ১৩ হাজার ৭০০ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, ভাতা জুড়ে যার পরিমাণ হবে অন্তত সাড়ে তেতাল্লিশ হাজার।
সরকারি কর্তারা অবশ্য জানাচ্ছেন, বেতনবৃদ্ধি যদি কার্যকর হয়ও, তা হলেও পশ্চিমবঙ্গে মন্ত্রীদের সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক কমই থাকবে। কর্তাদের বক্তব্য: নতুন বেতন কমিশনের পরে বিভিন্ন রাজ্য সরকার মন্ত্রী-বিধায়কদের বেতন-পেনশন সংক্রান্ত কমিশন গড়েছে। ২০১০-’১১ অর্থবর্ষ থেকে অন্যান্য রাজ্যের মন্ত্রীরা অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, বেতন-ভাতাও বেশি। এ প্রসঙ্গে ওড়িশা-অসম-বিহার-অন্ধ্রের দৃষ্টান্ত টেনে সরকারি এক সূত্রের মন্তব্য, “ওঁদের পাশে এ রাজ্যে জনপ্রতিনিধিদের মাইনে তো চোখেই পড়ে না! তা কর্মচারীদের চেয়েও কম!”
যদিও কর্মীদের বড় অংশ কর্তাদের এই তত্ত্ব মানতে নারাজ। এই মহলের যুক্তি, “মন্ত্রীদের বেতন কম। কিন্তু তাঁদের অন্যান্য খরচ-খরচা সরকারই জোগায়। গাড়ি, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা সবই। কর্মচারীদের তো মাইনের টাকাটুকুই সম্বল!” |