সরলরেখা আঁকিতেও অন্তত দুইটি বিন্দু প্রয়োজন। রাজনীতি, প্রাজ্ঞজনমাত্রেই বলিবেন, সরলরেখায় চলে না। অতএব, আজকের একটি লোকসভা উপনির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে রাজ্য রাজনীতির আগামী কাল অথবা পরশুর গতিপ্রকৃতির পূর্বাভাস করা বিপজ্জনক। তবে, রাজনীতির পারদ ঊর্ধ্বমুখী, পঞ্চায়েত নির্বাচনও শেষ পর্যন্ত হইতেছে। হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফল লইয়া জল্পনাকল্পনা চলিবে, তাহা স্বাভাবিক। ২০০৮-এর পঞ্চায়েত, ২০০৯-এর লোকসভা, ২০১১-এর বিধানসভা এবং ২০১৩ সালে নলহাটি-সহ তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফল মিলাইয়া ভোটবণ্টনের যে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান আছে, সংখ্যাতত্ত্বের বিশুদ্ধ বিচারে তাহা হয়তো বর্তমান উপনির্বাচনের ফলাফলের সহিত সরাসরি তুলনীয় নহে, কিন্তু এক্ষণে তাহাই সম্বল। সেই মাপকাঠিতে তিনটি প্রবণতা স্পষ্ট: তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের সম্মিলিত ভোট, জোট ভাঙার পরেও, কমে নাই; বামপন্থীদের রক্তক্ষরণ সাময়িক ভাবে হইলেও, সম্ভবত, থামিয়াছে; এবং, এই উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী দিলে ফলাফল বদলাইতে পারিত। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কোন পথে চলিবে, আপাতত তাহার রাজনৈতিক পাঠের ভিত্তি এইটুকুই।
হাওড়ার উপনির্বাচনের ফলাফলকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী ভাবে পড়িবেন? গত কয়েক মাসে তাঁহার সরকার এক সংকট হইতে পরবর্তী সংকটে যাত্রা করিয়াছে। সমাজের সর্বস্তরে বিপুল সমালোচনা শুনিতে হইয়াছে। তাহা সত্ত্বেও, একা লড়িয়া তৃণমূল কংগ্রেস ২৭,০০০ ভোটের ব্যবধানে জিতিয়াছে, এই ঘটনা মুখ্যমন্ত্রীর মনোবল বাড়াইবে বইকী। তিনি প্রত্যাশিত ভাবেই বলিয়াছেন, তাঁহাদের জোটের প্রয়োজন নাই। তবে— মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক স্রোত বুঝিবার ক্ষমতা অবিসংবাদিত— তিনি নিশ্চয়ই জানেন, কথাটির মধ্যে যতখানি রাজনৈতিক ভঙ্গি বা কৌশল আছে, ততখানি সত্য নাই। অনুমান, পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজনৈতিক পরিসরটির একেশ্বরী হওয়াই তাঁহার পাখির চোখ। প্রতিবেশী ওড়িশায় নবীন পট্টনায়ক যেমন রাজ্যের একাধিপতি হইয়াছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সম্ভবত তাহাই চাহেন। নবীন পট্টনায়ক যে ভঙ্গিতে বিজেপি-কে ত্যাগ করিয়াছেন, কংগ্রেসকে সেই ভঙ্গিতে ছাঁটিয়া ফেলিলে রাজ্যের বাম-বিরোধী রাজনীতির পরিসরটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একার হয়। কিন্তু, আপাত অকিঞ্চিৎকর কংগ্রেসকে বাদ দিলে তাঁহার কাঙ্ক্ষিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা মুখ্যমন্ত্রীর থাকিবে কি না, হাওড়ার উপনির্বাচন আবার সেই প্রশ্ন তুলিয়া দিল। বিজেপি প্রার্থী দিলে পদ্মফুলে যে ভোটগুলি পড়িত, তাহা কাহার ভাগ হইতে আসিত, সেই প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া কঠিন। কিন্তু কংগ্রেসের সহিত জোট থাকিলে তাহা লইয়া মুখ্যমন্ত্রীকে ভাবিতে হইত না। কংগ্রেসকে ছুড়িয়া ফেলার পথে এই ভাবনাই বৃহত্তম বাধা। নলহাটি সেই বাধার হিসাব জানে।
স্পষ্টতই, হাওড়ার উপনির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জল মাপিতেছিলেন। তিনি জানেন— বস্তুত কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রেই জানেন— একটি উপনির্বাচনের ফলাফলকে প্রাপ্যের অধিক গুরুত্ব দিতে নাই। পঞ্চায়েত নির্বাচন আসিতেছে। তাহাতে গোটা রাজ্যের নাড়ি টের পাওয়া যাইবে। এমন পূর্বাভাস করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, একা লড়িয়াই তৃণমূল কংগ্রেস ভাল ফল করিবে। কাজেই, পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিকে যে নজর থাকিবে, তাহা নিছক জয়ের সংবাদে সন্তুষ্ট হইবে না। দেখিবে, রাজ্যের অ-বাম ভোটের পরিসরটি কী ভাবে বণ্টিত হইতেছে। ২০১৪ সালের জন্য সেই হিসাব জরুরি। ২০১১ সালে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট যে ভোট পাইয়াছিল, ২০১৪ সালে তাহার পুনরাবৃত্তি হইবার সম্ভাবনা কম— ২০১১ ব্যতিক্রমী নির্বাচন ছিল। অন্য দিকে, ইউ পি এ’র হাল যেমন, তাহাতে বিজেপি-র ভোট গোটা দেশেই বাড়িবার সম্ভাবনা। এই অঙ্ক মাথায় রাখিয়াই রাজ্যের অ-বাম শক্তিগুলি পঞ্চায়েতের ফলাফল মাপিবে। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকিতে হইলে, এবং পশ্চিমবঙ্গের অ-বাম পরিসরের নেতৃত্ব ধরিয়া রাখিতে হইলে কংগ্রেসের সহিত জোট অপরিহার্য হইবে কি না, পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল মমতাদেবীকে তাহা বলিয়া দিবে। হাওড়ার উপনির্বাচনী ফল আভাসমাত্র। |