|
|
|
|
শুধু ধান নয়, মিশ্র চাষে জোর দিন, বার্তা কৃষিরত্নের |
বরুণ দে • খড়্গপুর |
ধান চাষ না হলেই সব শেষ বহু দিনের এই ধারণাটা ভেঙে দিয়েছেন তিনি। প্রমাণ করে ছেড়েছেন চিরাচরিত পন্থা আঁকড়ে থাকার বদলে মিশ্র চাষেও লক্ষ্মীলাভ সম্ভব।
তিনি খড়্গপুরের দীপক কর। কয়েতপুরের এই চাষি সেচের জলের অভাবে গত তিন বছর ধান চাষ করতে পারেননি। তাতে অবশ্য তাঁর সংসারের চাকা থেমে যায়নি। বরং
|
‘কৃষিরত্ন’ দীপক কর। নিজস্ব চিত্র। |
ফলের বাগানে মরসুমি গাছ ফলিয়ে আয় হয়েছে ভালই। আর এতেই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন দীপকবাবু। স্বীকৃতিস্বরূপ গত মার্চে পেয়েছেন ‘কৃষিরত্ন’। অন্য চাষিদের বিকল্প চাষে উত্সাহী করতে কৃষি দফতর দীপকবাবুকে শিবিরে নিয়ে যাওয়াও শুরু করেছে। সহ-কৃষি অধিকর্তা সুব্রত সাহার কথায়, “ওঁকে দেখে আরও অনেক চাষি উত্সাহিত হবেন। চাষে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করবেন। এখন তো মিক্সড ফার্মিংয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। অনেকেরই জমি পড়ে নষ্ট হয়। দীপকবাবু কিন্তু জমি ফেলে রাখেননি।” খড়্গপুর ১-এর বিডিও সুভেশ বেরা মানছেন, “ছেষট্টি বছরের ওই চাষিকে দেখে অন্যদের উত্সাহিত হওয়ার কথা।”
সব মিলিয়ে ১ একর ২৫ ডেসিমেল জমি রয়েছে দীপকবাবুর। এর মধ্যে ৪৬ ডেসিমেল জমিতে ফলের বাগান করেছেন। কী গাছ নেই সেখানে? আম, পেয়ারা, সবেদা, ডালিম থেকে কাঁঠাল, কামরাঙা, কাজু, লেবু, নারকেল আরও কত কী। বাগানের চারধারে আবার সেগুন, মেহগনি গাছের সারি। দীপকবাবুর কথায়, “সেচের ব্যবস্থা নেই। উঁচু জমিতে জলও দাঁড়ায় না। জমিটা পড়েই রয়েছে। তিন বছর ধরে চাষ করতে পারছি না। ফলের বাগান ছিল বলে রক্ষা।”
কৃষকদের বিকল্প চাষে উত্সাহী করতে নানা পদক্ষেপ করে কৃষি দফতর। তা সত্ত্বেও ধান চাষের বাইরে অন্য চাষের জনপ্রিয়তা খুব একটা বাড়ানো যাচ্ছে না বলেই কৃষি আধিকারিকদের মত। যাঁরা বিকল্প চাষ করছেন, তাঁরাও আটকে থাকছেন তিল বা সরষে চাষে। অথচ প্রথাগত এই সব চাষের বাইরেও বহু অর্থকরী ফসল রয়েছে, যা চাষির ভাগ্য বদলে দিতে পারে। তা-ও নতুন এই সব চাষে কৃষকেরা সচরাচর আগ্রহ দেখান না। এই অবস্থায় দীপকবাবু বাস্তবিকই দৃষ্টান্ত। ছেষট্টি বছরের প্রবীণ মানুষটি বুঝেছেন, শুধু ধান চাষ আঁকড়ে থাকলে চলবে না।
স্ত্রী আর তিন মেয়েকে নিয়ে সংসার দীপকবাবুর। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। গ্রামে বিদ্যুত্ পৌঁছেলেও এই প্রৌঢ়ের বাড়িতে সংযোগ আসেনি। জমিতেও জলসেচের বন্দোবস্ত নেই। এই অবস্থায় পরপর তিন বছর ধান চাষ না হলে অধিকাংশ চাষিই হতাশ হয়ে পড়তেন। দীপকবাবু কিন্তু উল্টো পথে হেঁটেছেন। আরও উদ্যোগী হয়ে ফলের বাগানের যত্ন নেওয়া শুরু করেছেন। বাগানে এখন ১০টি আম গাছ, ১৪টি পেয়ারা গাছ, ২টি সবেদা গাছ, ৩টি ডালিম গাছ, ১টি কাঁঠাল গাছ, ১টি কামরাঙা গাছ, ৬টি কাজু গাছ, ১টি লেবু গাছ এবং ১১টি নারকেল গাছ। সব মরসুমেই কিছু না কিছু ফল হয়। ফলে, বারো মাসই আয়ের পথ খোলা। দীপকবাবুর কথায়, “নিজে গাছের চারা তৈরি করি। ফল বিক্রি করতে খড়্গপুরে যাই। ক’দিন আগে পেয়ারা বিক্রি করে দেড় হাজার টাকা পেয়েছি।”
নিজের অভিজ্ঞতার আলোয় অন্য চাষিদের পথ দেখাতে পেরেও খুশি এই কৃষক। মেদিনীপুরে এক কৃষি শিবিরে এসে তিনি। বলেন, “শিবিরে গিয়ে অন্য চাষিদের বোঝাই, চাষে বৈচিত্র্য আনলে নিজেরই সুবিধে। ধান-তিলের সঙ্গে ফলগাছও লাগান। জমি ফেলে রাখবেন না।” নিজেও থেমে থাকতে চান না দীপকবাবু। ভবিষ্যতে ফলের বাগান আরও বড় আকারে করার ইচ্ছে রয়েছে তাঁর। তিনি বলেন, “লিজে জমি পেলে বড় ফার্ম করব। নিজের পরিকল্পনার কথা ব্লক আধিকারিকদের জানিয়েছি। দেখি কতদূর কী হয়।” উদ্যমী এই বৃদ্ধের সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী তপতীদেবীও। তাঁর কথায়, “আমাদের তো বড় কোনও চাওয়া-পাওয়া নেই। এ ভাবে সংসারটা চলে গেলেই হল।” |
|
|
|
|
|