প্রবন্ধ ২...
রাষ্ট্র ভুল পথে চলছে, মাওবাদীরাও
মার ছেলে আর বউমাকে নিয়ে খেতে ফসল কাটছি, হঠাত্‌ এসপিও আর সালওয়া জুড়ুম-এর গুন্ডারা হানা দেয়। আমাদের তিন জনকেই অকথ্য গালাগাল আর মারধর করতে থাকে। ওদের সন্দেহ, আমার ছেলে নকশাল সমর্থক। আমি কত বোঝানোর চেষ্টা করলাম,একটা কথা শুনল না। ছেলেটাকে নিয়ে গেছে মীরতুর থানায়, আজও ঘরে ফেরেনি সে। শুনেছি নাকি সে আর নড়তে পারে না। সালওয়া জুড়ুম আমাদের কাছে এক আতঙ্ক। ভয় হয়, আপনাকে এই চিঠি লিখছি, এ কথা জানাজানি হলে আমার...’
দান্তেওয়াড়া জেলার দোরগুডা গ্রামের বাসিন্দা মঙ্গুরাম ভোগামির স্ত্রী সাঙ্কি।
তত্‌কালীন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম।
ধ্বংসের পথ। বস্তারে মাওবাদী হানার পরে। ২৬ মে, ২০১৩। ছবি: এ পি।
আরও ক’টি ঘটনা। ১৬ নভেম্বর, ২০০৬, বাবার জন্যে খাবার নিয়ে ক্ষেতে যাওয়ার সময় গোল্লাগুড়া গ্রামের অনুরাধা (বয়স ১৬)-কে ধর্ষণ করা হয়। ভানসি গ্রামে সোনিয়াকে বেধড়ক পিটিয়ে জিপের পিছনে বেঁধে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। অপরাধ? সালওয়া জুড়ুমের অত্যাচার নিয়ে সংবাদমাধ্যমে মুখ খোলা। ২০০৫-এর ১ সেপ্টেম্বর, বদরি, মুন্নি, সোমলি-দের গণধর্ষণের পর রক্তাক্ত, নগ্ন অবস্থায় হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। প্রতি ক্ষেত্রেই অভিযোগের তির সালওয়া জুড়ুমের দিকে।
সালওয়া জুড়ুম (যার অর্থ শুদ্ধিকরণ অভিযান) মাওবাদী সন্ত্রাস রুখতে ছত্তীসগঢ়ের আদিবাসীদের নিয়ে গড়া এক পাল্টা সামরিক বাহিনী, যার প্রত্যক্ষ সহকারী ও মদতদাতা তত্‌কালীন রাজ্য সরকার, পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী। আর এই বাহিনী গঠনের পিছনে যাঁদের ভূমিকা ও উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি, তাঁদেরই এক জন মহেন্দ্র কর্মা, যাঁর বিরুদ্ধে একাধিক বার আঙুল উঠেছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সালওয়া জুড়ুমের ঘটানো অত্যাচার, ধর্ষণ ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত থাকার। যাঁকে খুন করে আনন্দে নাচগান শুরু করেন মাওবাদীরা। অন্তত সাক্ষীদের বক্তব্য তেমনটাই।
এ হেন মহেন্দ্র কর্মার খুনের পর নানা সর্বভারতীয় মিডিয়াতে যে নেতা-নেত্রীরা বিবিধ দলের পক্ষ থেকে বক্তব্য রেখেছেন: ‘দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ বা থ্রেট মাওবাদী সন্ত্রাস।’ প্রত্যেকটি মাওবাদী হামলার পরে এমনটাই হয়ে এসেছে। কিন্তু এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে আর একটা ব্যাপার চোখে পড়ছে। কসাবের ফাঁসি বা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজির মৃত্যুর ঘটনা যখন সংবাদমাধ্যমগুলি প্রচার করে, তখন দেখা যায় ‘ফাঁসি’ বা ‘এনকাউন্টার’ পদ্ধতির যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দেওয়া হয় এঁরা কী কী অপরাধ করেছেন তার উপরেও। কিন্তু সাম্প্রতিক মাওবাদী হামলার নিন্দা যত হচ্ছে, সমপরিমাণ আলোকপাত কি করা হচ্ছে মহেন্দ্র কর্মার অপরাধ নিয়ে? রাষ্ট্র বা মাওবাদী, উভয়ের সন্ত্রাস সমান গুরুত্বসহ বিশ্লেষণ মিডিয়ার দায়িত্ব নয় কি?
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সালওয়া জুড়ুম অবৈধ ঘোষণার পরেও মহেন্দ্র কর্মার বিরুদ্ধে কোনও তদন্ত, আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। উল্টে, এখন তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হচ্ছে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ ছত্তীসগঢ়ে সালওয়া জুড়ুম এখনও ঘুরপথে সক্রিয়। নামটা পাল্টেছে, গ্রাম হয়তো আর জ্বালিয়ে দেওয়া হয় না। কিন্তু নিষ্ঠুর কাজকর্ম অব্যাহত। সে সব খবর বাইরে আসে না খুব একটা। বিশেষ করে বিজাপুরের এক পুলিশকর্তা ও তাঁর অধস্তনের কথোপকথনের একটি টেপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর থেকে: ‘নকশালদের নিয়ে রিপোর্ট করতে সাংবাদিকরা এলে, যেন বেঁচে ফিরতে না পারে।’
সন্ত্রাস মাওবাদী হোক কিংবা রাষ্ট্রীয় নিন্দনীয়। মার ও পাল্টা মার এক বার চালু হয়ে গেলে এক সময়ে তা পর্যবসিত হয় ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ গোত্রের আন্দোলনে। প্রধান হয়ে ওঠে এই মারামারি আর তজ্জনিত নৃশংসতা, গৌণ হয়ে যায় আন্দোলনের উদ্দেশ্য বা মারামারির কারণ তথা মূল প্রশ্নগুলো। যেমন, মাওবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে দ্রুত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে আদিবাসী উন্নয়ন, অরণ্যের অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো। প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন বটে, ‘উন্নয়ন ছাড়া মাওবাদী সমস্যার পূর্ণ সমাধান সম্ভব নয়,’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে তীব্রতায় মাওবাদী সন্ত্রাসের মোকাবিলা করে কেন্দ্রীয় বাহিনী, উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার এক শতাংশ ক্ষিপ্রতা কেন্দ্রের নেই।
আর, ‘উন্নয়ন’ মানে কী? স্রেফ পানীয় জল আর এক টাকা কেজি দরে চাল? সেটুকুও তো সর্বত্র পৌঁছয়নি। স্কুল কলেজ, চিকিত্‌সা, কর্মসংস্থান, এ সব তো অনেক পরের কথা। কিন্তু এ কথাও ভুললে চলবে না যে, দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অনুন্নয়নের ফলে আদিবাসীদের মনে তৈরি হয়েছে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা, প্রাণের চেয়েও তাঁদের কাছে অনেক মূল্যবান তাঁদের নিজেদের সংস্কৃতি, অরণ্যের মধ্যে যা বহু বছর ধরে সযত্নে লালিত। খনিজ পদার্থ আহরণ আর শিল্পস্থাপনের নামে জঙ্গল কেড়ে নিলে আঘাত হানা হয় তাঁদের বিশ্বাসে, সংস্কৃতিতে। ‘পুনর্বাসন’ শব্দটাই তাঁদের কাছে অর্থহীন। রাষ্ট্রকে এই সমস্যার যথার্থ সমাধান করতে গেলে সহিষ্ণু হতে হবে, বুঝতে হবে, ওঁদের বাস্তবটার সঙ্গে রাষ্ট্রের নিজের বাস্তবের একটা ফরাক আছে। সেই ফারাক না ঘুচলে আলোচনা কোনও দিন শুরুই হবে না, সফল হওয়া তো দূরে থাক।
অন্য দিকে, মাওবাদীদের ভুলও প্রচুর। রাষ্ট্র যদি উদ্ধত হয়ে থাকে, তাঁরাও অনমনীয় মনোভাব নিয়ে বসে আছেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, আজও আদিবাসীরা সবচেয়ে অবহেলিত। ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হওয়া অত্যন্ত সঙ্গত। কিন্তু সেই ক্ষোভের প্রকাশ? প্রথমত, অনেক মাওবাদী সমর্থককে বলতে শুনেছি ‘স্বাধীনতা যুদ্ধেও তো জেনারেল ডায়ারকে মারা...’। এটা কোনও যুক্তি হতে পারে না, যে যতই নৃশংস হোক, তাদের প্রাণ নেওয়ার কোনও অধিকার কারও নেই।
দ্বিতীয়ত, অত্যাচারী (সে দিনের ডায়ার বা এ দিনের রাষ্ট্রশক্তি)-র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও ‘মাথা চাই’ মর্মে বন্দুক তুলে নেওয়া ছাড়া আর কি সত্যিই কোনও রাস্তা নেই? না কি মাওবাদী নেতা-নেত্রীদের দূরদর্শিতার অভাব, যে তাঁরা এখনও কিছু উপযুক্ত বিকল্প ভেবে উঠতে পারেননি। ভেবে দেখলে, কুড়ানকুলাম বা পস্কো-বিরোধী আন্দোলনের মতো কোনও রাস্তায় যদি এগোনো যায়, যেখানে আন্দোলনের পদ্ধতি হবে মূলস্রোতের রাজনীতির চলতি ছকের বাইরে, অথচ কোনও মানুষকে হত্যা করতে হবে না? হ্যাঁ, এ ধরনের আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। প্রচারের অভাবে বা (অনেক সময়েই রাষ্ট্রের কারসাজিতে) বিভেদ সৃষ্টির ফলে কিংবা দমন-পীড়নের জন্য প্রতিবাদ বিক্ষোভ ঝিমিয়ে পড়ে, ক্রমে মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়। কিন্তু মাওবাদীদের সাংগঠনিক ক্ষমতা, মেধা, অভিজ্ঞতা এবং আন্দোলনকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই, চাইলে তাঁরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে লাগাতার চাপ বজায় রাখতে পারেন রাষ্ট্রের উপর। আবার অন্য দিকে, যাঁরা ‘সশস্ত্র’ আন্দোলনের পদ্ধতির বিরোধী, কিন্তু মাওবাদীদের উদ্দেশ্য তথা আদিবাসী উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে একমত, সেই বিপুলসংখ্যক মানুষকেও হয়তো তাঁরা পাশে পাবেন। এটা করতে না পারলে কিন্তু ক্রমে কোণঠাসা হয়ে একদিন তাঁরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবেন জাতীয় রাজনীতিতে, আদিবাসীদের উন্নয়নের সম্ভাবনাও আর থাকবে না। রাষ্ট্রের হাতে গোলাবারুদ কিন্তু অনেক বেশি, মাওবাদীদের চেয়ে।
তৃতীয়ত, ভারতীয় রাজনীতিতে জন্মলগ্ন থেকে বামেরা যে ভুল করে চলেছেন, মাওবাদীরাও তার ব্যতিক্রম নন। মার্ক্স-মাও-লেনিন-স্ট্যালিন’কে তাঁরা রাশিয়া-কিউবা-চিন বা নেপালে দাঁড়িয়ে পড়ছেন, ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে নয়। অথচ, স্বয়ং মাও বলেছেন, শত্রুপক্ষকে হারাতে তাঁর তিনটি অস্ত্রের অন্যতম: মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের অস্ত্রে বলীয়ান একটি সুশৃঙ্খল পার্টি, যে পার্টি আত্মসমালোচনার পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং জনগণের সঙ্গে যার গভীর সংযোগ আছে। ভারতের জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক বিস্তারের কথা মাথায় রেখে, বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে সংযোগ না হারিয়ে, মার্ক্স-মাও-লেনিনের ‘ভারতায়ন’ ঘটানোর জন্য যে আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মসমালোচনার প্রয়োজন, তা কি করছেন মাওবাদীরা? উল্টে, অস্ত্র কেনার জন্য ইসলামি মৌলবাদী শক্তির লগ্নি স্বীকার করে তাঁরা দীর্ঘমেয়াদি বিপদ ডেকে আনছেন। অজুহাত দিচ্ছেন, ‘ওদের লড়াই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে, আমাদেরও লড়াই মার্কিন মুলুকের পা-চাটা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে, আমরা সহযোদ্ধা।’ অন্তত মুম্বই হামলার প্রেক্ষিতে কিষেণজির দেওয়া সাক্ষাত্‌কারটি পড়লে তেমনটাই মনে হয়। স্বল্পমেয়াদি সাফল্যের লোভে মাওবাদীরাও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনছেন। বামফ্রন্টের মতোই। কেন?
এই ‘কেন’গুলোর উত্তর কেউ খুঁজছেন না। মিডিয়াও নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.