সালওয়া জুড়ুম নিঃসন্দেহে জঙ্গিবাদ বিরোধী। কিন্তু দমন-পীড়ন দিয়ে জঙ্গিবাদের মোকাবিলা
করতে যাওয়া যাকে বলে
কাউন্টার-প্রোডাক্টিভ হয়ে যাচ্ছে না তো? উসকে দিচ্ছে না তো আরও হিংসা আর প্রতিশোধপরায়ণতা?
কৃষ্ণা বসু |
দেশের কোনও খারাপ খবর প্রবাসে থাকার সময়ে শুনতে হলে মনে জোর ধাক্কা লাগে। ইন্টারনেট খুলে খবর পড়তে গিয়ে তেমনই এক চমক লাগল। এক শনিবারের বারবেলায় মাওবাদীরা তাণ্ডব জালিয়েছে ছত্তীসগঢ়ে। পরিবর্তন যাত্রায় চলেছিলেন যে রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ, তাঁদের ঘিরে ফেলে কয়েক শত মাওবাদী নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে, হতাহতের সংখ্যা ভয়াবহ। তুলে নিয়ে গিয়েছে নন্দকুমার পটেল ও তাঁর পুত্র দীনেশকে। জীবিত ফিরে পাবার আশা তখনই সুদূরপরাহত। অবশ্যই মাওবাদীদের প্রধান টার্গেট মহেন্দ্র কর্মা। সালওয়া জুড়ুম আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রধান। সালওয়া জুড়ুম নিঃসন্দেহে জঙ্গিবাদ বিরোধী। কিন্তু দমন-পীড়ন দিয়ে জঙ্গিবাদের মোকাবিলা করতে যাওয়া যাকে বলে কাউন্টার-প্রোডাক্টিভ হয়ে যাচ্ছে না তো? উসকে দিচ্ছে না তো আরও হিংসা আর প্রতিশোধপরায়ণতা? |
নিহত ব্রিটিশ সেনার স্মৃতিতে। লন্ডন, ২৩ মে, ২০১৩। ছবি: রয়টার্স। |
সপ্তাহের গোড়াতেই দেখা হয়েছিল ওয়াশিংটনে আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে। তাঁরা এসেছেন আমেরিকান প্রশাসনের হোমল্যান্ড সিকিয়োরিটি যাঁরা দেখেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে। জঙ্গিবাদ দমনের বিভিন্ন প্রথা নিয়ে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে। অর্থাত্, যখন ওয়াশিংটনে এই কনফারেন্স চলছে, ছত্তীসগঢ়ের টোঙ্গাপাল ও দরভার মধ্যে নিবিড় অরণ্যে মাওবাদীরা তখন তাদের আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। সুকমা-জগদলপুর জাতীয় সড়কের উপর ল্যান্ডমাইন পুঁতে, গাছ কেটে পথে আটকাবার সব ফন্দিফিকির করে চলেছে। এক ধরনের নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস!
সরকারি বৈঠকে নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা হয়েছিল, বাইরের লোকদের জানার কথা নয়। কিন্তু অন্য ভাবে দেখাসাক্ষাত্ হওয়াতে কিছু আলাপ-আলোচনা কানে তো এল। আমাদের রাষ্ট্রদূত বার্তা পাঠালেন, তিনি যে আনুষ্ঠানিক রিসেপশন ও নৈশভোজের আয়োজন করেছেন, সেখানে আমি উপস্থিত থাকলে খুশি হবেন। মনে করিয়ে দিলেন, ‘ম্যাডাম, আপনার পুরনো পরিচিত সহ-সাংসদ সুশীলকুমার শিন্দেজি এসেছেন।’
অতীতে কোনও এক সময়ে আমরা তিন জন মহিলা আমাদের সে সময়ের বিদেশমন্ত্রীকে ঘিরে থাকতাম। বর্তমান রাষ্ট্রদূত নিরুপমা তখন স্পোকসপার্সন, আমি বিদেশ মন্ত্রক পার্লামেন্টারি কমিটির দায়িত্বে আর মহিলা বিদেশ সচিব তখন চোকিলা আইয়ার। তিন মহিলার কলকাকলির মধ্যে তদানীন্তন বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিংহের ব্যারিটোন কণ্ঠস্বরে হুম্-হাম্ চাপা পড়ে যেত। সুশীলকুমার শিন্দে আমার কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বিদেশে দৈবের বশে দেখা হয়ে ভাল লাগল, পুরনো সেই দিনের কথা কিছু হল।
আমাকে যা একটু আশ্চর্য করল, নিরুপমার এই আমন্ত্রণে আমেরিকান প্রশাসনের অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তির উপস্থিতি। রয়েছেন ওবামা ক্যাবিনেটের সদস্য জ্যানেট নেপালিটানো। তিনি ছোটখাটো বক্তৃতাও করলেন। রবার্ট ব্লেক আমাদের পুরনো বন্ধু, দিল্লিতে ছিল বেশ কিছু দিন। এখন অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি অব স্টেট, সাউথ এশিয়ার ভারপ্রাপ্ত। আরও অনেক ধুরন্ধর সব কূটনীতিক। এক ভারতীয় ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স-এর অধ্যাপক আমাকে সঙ্গোপনে বললেন, ‘আমেরিকানরা আজকাল আমাদের ভারতীয়দের বেশ খাতির করছে। কারণটা বুঝলেন তো চিনের উত্থান!’ হতেই পারে।
মনে পড়ল ভারত-আমেরিকার সুসম্পর্কের সূচনা আমি দেখেছিলাম, যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্লিন্টন ডেলিগেশন নিয়ে এলেন দিল্লিতে। পার্লামেন্টের যুগ্ম অধিবেশনে বক্তৃতা করলেন। তাঁর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার জন্য কাড়াকাড়ি, আমাদের বামপন্থী বন্ধুরাও বাদ যাননি।
সব দেশের বিদেশ নীতি নির্ধারিত হয় নিজের দেশের স্বার্থের উপর। যদি এক যুগ পরে ভারত-আমেরিকান সম্পর্ক অটুট থাকে, ভাল কথা। আর এখন তো সন্ত্রাস-বিরোধী সব দেশ একসঙ্গে হয়ে লড়তে হবে। এক সময় আমাদের সন্ত্রাসজনিত সমস্যার কথা বলে বলে হয়রান হয়েছি, আমেরিকা বুঝতে চায়নি। যখন ৯/১১ হল, টুইন টাওয়ার ধ্বংস হল, তখন বুঝল। আর আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যারা এক দিন সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দিয়েছে, আজ স্বখাতসলিল থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজছে।
রাষ্ট্রদূত নিরুপমা খুব গুছিয়ে ভারতের সন্ত্রাসের সমস্যার উপর বক্তৃতা করলেন। সুশীল শিন্দেও বক্তব্য রাখলেন। ওঁর মুখে হাসিটি লেগেই থাকে, তা সামনে যত কঠিন সমস্যাই থাক। হয়তো হালকা করার জন্য উনি আমাদের পুরনো দিনের সখ্যের কথাও বললেন। এক লম্বা আমেরিকানকে অনেকক্ষণ ধরে চেনা লাগছে। নিরুপমা বললেন, আমেরিকান কংগ্রেসের সদস্য, ইন্ডিয়ার জন্য খুব কাজ করেন। এ বার আমরা পরস্পরকে চিনতে পারলাম। অনেক কাল আগে তখনকার রাষ্ট্রদূত ললিত মান সিংহ ক্যাপিটল-এ এক অনুষ্ঠানে আমার হাত দিয়ে ‘ভারত মিত্র’, ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া অ্যাওয়ার্ড দিয়েছিলেন। জো ক্রাউয়ির হাতে আমি অ্যাওয়ার্ড তুলে দিয়েছিলাম। জো দীর্ঘদেহী, আমি নিতান্ত ছোটখাটো। পরদিন কাগজে ছবি দেখে কে যেন বলেছিল, ‘দ্য লং অ্যান্ড দ্য শর্ট অব ইট হল’, এই মৈত্রী বজায় থাকুক।
বিভিন্ন টেবিল-এ সিটডাউন ডিনার। আমার সেন্ট্রাল টেবিলে শিন্দের পাশে জ্যানেট আর জো আছে। আমার বাঁ দিকে যিনি, নামের কার্ড দেখে চমকে গেলাম, এফ বি আই-এর কর্তাব্যক্তি। খুব সতর্ক হয়ে কথাবার্তা বলতে হবে ভাবলাম। দেখলাম, তিনি খুব চার্মিং ব্যক্তিত্ব। ফুটবল খেলা, ক্রিকেট ম্যাচ কত বিষয়ে কথা হল, রাজনীতি নৈব নৈব চ। মনে ভাবলাম, আমাদের ইনটেলিজেন্স অফিসাররা দেখে শিখলে পারে। এ সব কাজে ভীতিপ্রদ বা গোমড়ামুখো হলে আসল কাজ করা যায় না।
ছত্তীসগঢ়ের হিংস্র তাণ্ডব আবার আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে, কী ভাবে সন্ত্রাস ঠেকানো যাবে। সরকারি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াগুলি বড় বিরক্তিকর। ক্ষতিপূরণ পাঁচ লক্ষ, দুই লক্ষ ইত্যাদি। প্রাণের বিনিময়ে, খেলো শোনায়, সন্ত্রাস দমনে সাহায্য করে না। ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ ঘোষণা করেছেন দুই বিচারপতি দিয়ে তদন্ত। এই তদন্ত কমিটি ব্যাপারটা ইংরেজরা শিখিয়ে গেছে আমাদের, গোলমাল ধামাচাপা দেবার বা বিলম্বিত করার শ্রেষ্ঠ উপায়। শিন্দে ওয়াশিংটন থেকেই ঘোষণা করলেন, ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স সংস্থা ভার নেবে তদন্তের। হয়তো তারা বলতে পারবে জাতীয় সড়ক অরক্ষিত থাকে কেন। অনেকে অভিযোগ করছেন, রাজনৈতিক দলটির জন্য উপযুক্ত পুলিশি প্রহরা ছিল না কেন?
কিন্তু এই কি জীবন? পুলিশি প্রহরা রাখতে হবে সর্বত্র, তা সে কলকাতার প্রেসিডেন্সির চত্বরই হোক বা বস্তারের দুর্গম জঙ্গল! টেলিভিশন খুলে দেখছি, রক্তাক্ত হাতে ছুরি নিয়ে এক কালো মানুষ লন্ডনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছে, পাশে পড়ে আছে, সে সদ্য যার মুণ্ডচ্ছেদ করেছে, তার দেহ! এ কোথায় বাস করছি আমরা! গাঁধীজির কথা মনে পড়ল। তিনি কোথায়? ইংরেজিতে একটা কথা আছে: ‘টার্নিং ইন হিজ গ্রেভ’ শান্তির জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, মৃত্যুর পরও শান্তি পেলেন কি না জানা নেই। |