|
|
|
|
হুল্লোড় |
পরিচালক সহ-অভিনেতা হলে ভয় হয়
সেই কারণেই ছ’বছর নাটক করেননি। তবু ‘সিনেমার মতো’র জন্য
পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায় কেন ভাঙলেন সেই পণ? জানাচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত-কে |
শুনেছি আপনি নাকি প্রথমে ব্রাত্য বসুর ‘সিনেমার মতো’-তে অভিনয় করার ব্যাপারে নিমরাজি ছিলেন...
হ্যাঁ, তা ঠিক।
আপনি নাকি ব্রাত্যকে বলেছিলেন যে উনি অভিনয় করলে আপনি নাটকটি করবেন না...
এটাও ঠিক। তবে এটা বলার পিছনে একটা কারণ ছিল মানসিক। মাঝখানে ছ’বছর আমি থিয়েটার থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। ব্রাত্যকে জিজ্ঞেস করি ‘সিনেমার মতো’ করে আবার নাটক থেকে পালাতে হবে না তো?
পালাতে হবে কেন?
আমার জীবনে পাঁচ জন নাট্যগুরু। অরুণ মুখোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, অসিত মুখোপাধ্যায়, রমাপ্রসাদ বণিক। আর ব্রাত্য বসু। এঁদের মধ্যে একজনের সঙ্গে থিয়েটার করতে গিয়ে আমি থিয়েটার ছেড়ে পালিয়ে যাই। প্রথমে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ছিল আমাদের। তার পর আমরা একসঙ্গে অভিনয় করতে শুরু করি। কয়েকটা শো করার পর থেকে দেখি উনি আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেছেন।
কী ভাবে সেটা বুঝলেন?
কয়েকটা শো ঠিকঠাক হয়েছিল। তার পর হঠাৎ দেখি আমার অভিনয় ওঁর পছন্দ হচ্ছে না। সে সময়ে আমি সিরিয়াল করে খানিকটা জনপ্রিয়। ওই নাটকটার শো করতে আমরা বাংলার বাইরে গিয়েছি। সেখানে অনেকেই আমার সিরিয়াল দেখেছেন। গ্রিনরুমে তাঁরা ভিড় করতেন। সেখান থেকেই ওঁর খারাপ লাগাটা শুরু। তবু বলব আমি আজও ওঁকে গুরু মনে করি। ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে অভিনয় করতে আসা আমার। থিয়েটার থেকে তো আর্থিক লাভ সে রকম হয় না। যদি আত্মিক উত্তরণও না হয়, তা হলে সেটা করে লাভ কী? আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাইনি। ঠিক করি থিয়েটার ছেড়ে দেব। তবে ছেড়ে দেব ঠিক করার পরেও আমি আরও দু’টো শো করেছিলাম। যাতে আমার বদলে যিনি অভিনয় করবেন তিনিও সময় পান চরিত্রটা রপ্ত করতে।
ছ’বছর লাগল সেই ভয় কাটাতে?
মাঝখানে সুযোগ এসেছিল। মেঘনাদ ভট্টাচার্য বলেছিলেন ‘কর্ণবতী’তে অভিনয় করতে। দারুণ বড় সুযোগ। কিন্তু আমি বলেছিলাম: ‘তুমি (পরিচালক) যদি অভিনয় করো, আমি করব না’। মেঘনাদদা ইতিহাসটা জানতেন। বলেছিলেন: ‘কারও কারও বাড়ির ওয়্যারিং খারাপ থাকে। তাই শর্ট সার্কিট হয়। তবে সেই জন্য তো ইলেকট্রিসিটিকে দোষ দেওয়া যায় না!’ কী দামি কথা। তবু রাজি হইনি। ব্রাত্যর সঙ্গে একদিন আকাডেমিতে দেখা। ‘ভাইরাস এম’ বলে একটা নাটক করার কথা বলেছিল। মুখ্য ভূমিকায় দেবশঙ্কর হালদার আর আমি। ওর নির্দেশনায় পরে করি ‘সতেরোই জুলাই’, ‘বাবলি’ আর ‘ঈশ্বর মৃত্যু যৌনতা’। |
|
তাও কেন ‘সিনেমার মতো’ করতে দ্বিধা বোধ করতেন আপনি?
ব্রাত্যর সঙ্গে অভিনয় করতে হবে শুনেই দ্বিধা হয়েছিল। ও আশ্বাস দিয়েছিল যে সেটা হবে না। ব্রাত্য মন্ত্রী হওয়ার পরে আমি ওর থেকে কোনও বাড়তি সুযোগ নিইনি। কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা হলেই বলতাম, ‘কী রে কবে নাটক লিখবি শালা?’
ব্রাত্যর সঙ্গে নাটক করার অভিজ্ঞতাটা কেমন?
এখন ব্রাত্য অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আগে দেখতাম অভিনয় করতে গিয়ে একটা সংলাপ ভুল বললে, উইংসে ব্রাত্য দাঁড়িয়ে নিজের মাথা ঠুকছে। আমি কত বার বলেছি, ও ভাবে হাফ টাইম বলিস না। পরের হাফটা খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু ওর কাছে শব্দ ব্রক্ষ্ম। ভুল করলে পাগলা ভল্লুকের মতো ঘুরে বেড়াতে দেখেছি ওকে। একবার ‘সতেরোই জুলাই’য়ে অভিনয় করতে গিয়ে শেষ দৃশ্যে আমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়। এই যে দেখুন ভুরুর কাছে একটা স্টিচ। এটা ওই শো করতে গিয়ে হয়েছিল। কপাল দিয়ে রক্ত পড়ছে। সবাই আমাকে নিয়ে পিজি-তে ছুটছে স্টিচ করাতে। ব্রাত্য হলের বাইরে। আমাকে বলল: ‘আজকেও দু’টো ডায়লগ ভুল করলি!’ সব শোনার পরে যখন কথা হল, তখন ও স্নেহমাখা লজ্জায়, ভালবাসায় এক অন্য ব্রাত্য। এ সব বলছি এটাই বোঝাতে যে ব্রাত্যর প্যাশনটা আমার দারুণ লাগে। তবে এখন ব্রাত্যর বকুনির ধরনটা পালটেছে।
মানে?
এই তো ‘সিনেমার মতো’র দ্বিতীয় শো-তে আমি তোতলাচ্ছিলাম একটা জায়গায়। হাফ-টাইমে আমাকে আবার বকুনি! অনেকের সামনেই। কিন্তু আমার এ নিয়ে রাগ হয় না। কারণ ভাল বলার লোক থাকে । তবে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার লোক কই? আরেকটা মজার কথা বলি। হাফ টাইমে আমি ওয়াশরুম গিয়েছি। ব্রাত্য বলল: ‘ওই যে তুই জুতো পরতে পরতে স্টেজ থেকে বেরোলি, এটা দারুণ করেছিস!’ আমি বলছি ‘ব্রাত্য আমাকে বেরোতে দে, তার পর বলিস।’ নাহ, ওর তখনই বলা চাই!
সিরিয়ালের ভিড়ে নাটকের এই ভিন্ন সুরে বাঁধা অভিনয়টা কী ভাবে করেন?
নাটক না সিরিয়াল কোনটা করব, এ নিয়ে একটা টালমাটাল চলতেই থাকে। আপনি কী জানেন অক্টোবর ২০১১ থেকে মার্চ ২০১৩ অব্দি প্রায় কোনও সিরিয়ালে কাজ ছিল না আমার? তখন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়-এর ‘ব্রেন’ নাটকটি করি। আর দু’একটা সিনেমা। নাটক বা সিনেমা করে ভাল রিভিউ, দর্শকের প্রশংসা পাই। কিন্তু সিরিয়াল করে রোজকার জীবনের খরচা মেটাতে পারি। ‘কেয়াপাতার নৌকো’ আর ‘জলনূপুর’ করে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছতেও পারছি আমি। সিরিয়াল যদি আমাকে দশ টাকা দেয়, থিয়েটার দেয় দু’টাকা। নাটক করতে গেলে রিহার্সাল দরকার। এখন সিরিয়াল করা মানে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই দিয়ে রাখতে হয়। হঠাৎ করে ঠিক হয় শু্যটিং হবে। কোনও অভিনেতাই বেশি আগে কল টাইম জানতে পারেন না। টিআরপি দেখে ঠিক হয় কোন ট্র্যাকটা নিয়ে স্ক্রিপ্টটা লেখা হবে। এই রকম একটা অবস্থাতে কী করে আমি বলব যে অমুক দিন সিরিয়ালে ছুটি চাই যাতে নাটকের রিহার্সাল করতে পারি? কেউ কেন আমার জন্য এই কনসেশনটা করবে?
এই যে টিআরপি নামক একটা ‘জুজু’, এটা কি তা হলে সব অভিনেতার জীবন টালমাটাল করে দিচ্ছে?
হ্যাঁ। ও তো ভগবানের মতো। দেখা না পেলেও বিশ্বাস রাখতেই হবে। প্রতি বুধবার ওই টিআরপি চার্ট এলেই সবার জীবনটা পাল্টে যায়।
কোনও দিন দেখেছেন টিআরপি কী ভাবে মাপা হয়?
মাত্র এক বার। বারাসতে একটা বাড়িতে মেশিনটা লাগানো ছিল দেখেছি। |
|
|
‘আমোদিনী’-তে পীযূষের সঙ্গে
রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অনুশ্রী দাস |
‘গয়নার বাক্স’-তে পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়,
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় এবং পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
সাক্ষাৎ ভগবান দর্শন হয়েছিল তা হলে আপনার?
হ্যাঁ, হয়েছিল। এখন তো আবার এমন চার্টও আসে, যেখানে বলা হয় কোন ট্র্যাকটা চোদ্দো বছরের বেশি বয়সিরা পছন্দ করছেন! আর অমনি সব ওলটপালট হয়ে যায়।
তা হলে কি টেলিভিশন করা থিয়েটার-এর থেকেও শক্ত? প্রস্তুতি ছাড়াই দর্শককে টানতে হবে...
অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। চট করে ফুলকো লুচি বানিয়ে দেওয়ার মধ্যে যে চ্যালেঞ্জ থাকে, সে রকমই একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু শু্যটিং শেষ মানেই ইমোশনাল প্যাক-আপ। আজ আমাকে ‘মেঘের পালক’ বা ‘সেদিন দু’জনে’ থেকে কোনও ডায়লগ বলতে বলুন, আমি হয়তো পারব না। কিন্তু তেইশ বছর আগে করা ‘মারীচ সংবাদ’ থেকে মারীচের ডায়লগ আমার আজও মুখস্থ। শিরায় শিরায় থিয়েটার বইছে আমার।
আপনার বড় পর্দায় হাতেখড়ি হয়েছিল চিদানন্দ দাশগুপ্তর ‘আমোদিনী’-তে। তাও কেন সিনেমাতে এত কম দেখা গিয়েছে আপনাকে?
সবই কপাল। ‘আমোদিনী’-তে আমি মুখ্য চরিত্র। পুণ্ডরীকাক্ষ। আমার সঙ্গে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় আর অনুশ্রী দাস। কুড়ি বছর আগে, রিনাদির বাড়িতে ফোটোশু্যট করেছিলাম। রিনাদি ওয়ার্কশপও করিয়েছিলেন। যখন রিনাদি ‘গয়নার বাক্স’-তে আমাকে আবার ডাকলেন, মনে হল বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল। শেখর দাসের ‘মহুলবনীর সেরেং’ করেছি। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘অটোগ্রাফ’, অঞ্জন দাসের ‘ইতি শ্রীকান্ত’, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ল্যাপটপ’, অরিন্দম শীলের ‘আবর্ত’ করেছি। সঙ্গে অঞ্জনদার দু’টো ব্যোমকেশও। তবে প্রচার হয়নি সে ভাবে। অনেকের দশ পয়সার কাজ করলে আশি পয়সার প্রচার হয়...
আর আপনার কি আশি পয়সার কাজ করলে পাঁচ পয়সার প্রচারও হয় না?
আমি সুযোগ কম পেয়েছি। সংখ্যায় ছবি কম হলেও আমার অভিনীত চরিত্রগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নাটকের জন্য প্রশংসা পাই। ইন্ডাস্ট্রিতে কেউ আমার সম্পর্কে কটু কথাও বলে না। আশা করি চুল সাদা হলে হয়তো ডাক পাব।
‘সিনেমার মতো’-তে আপনার চরিত্রটি টালিগঞ্জে ছবি চালানোর উপায় বাতলে দিয়েছেন। সেটার সঙ্গে কি আপনি একমত?
দারুণ ডায়লগগুলো। ছবি বানানোর আগেই নাকি প্রযোজকদের সঙ্গে পরিচালকদের কথা বলে নিতে হবে দেড়শো হোর্ডিংয়ের জন্য। সেটা দরাদরি করে আশিতে এসে ঠেকবে। ছবি চালাতে গেলে প্রয়োজন পাবলিসিটি, হোর্ডিং, মিডিয়া ম্যানিপুলেশন আর ক্ষমতাশালী লোকেদের মধ্যস্থতা। এগুলো একেবারেই খাঁটি কথা।
নিজে এটা প্রয়োগ করছেন না কেন?
অপেক্ষা করব। কিন্তু এটা পারব না। |
|
|
|
|
|