বিরোধী থেকে সংবাদমাধ্যম, সব দিকে সমালোচনার মুখে পড়ে আগের অবস্থান থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেলেন তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল।
রবিবার বীরভূমের রামপুরহাটে কর্মীদের উদ্দেশে যাঁর নির্দেশ ছিল, বিরোধীদের ‘মনোনয়ন দিতে দেবেন না’, সোমবার সেই অনুব্রতবাবুই বললেন, “আজ আমি বলছি, কোনও দল যদি মনোনয়ন দাখিল করতে না পারে, আমায় ফোন করুন। আমাদের কার্যালয়ে আসুন।” তবে বামেরাও এ দিন দেখিয়ে দিয়েছে, গণ্ডগোল পাকানোয় তারা তৃণমূলের চেয়ে কোনও অংশে কম যায় না।
তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এ দিনই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে কংগ্রেস এবং বিজেপি। তাঁকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার কটাক্ষ, “অনুব্রতবাবু তাঁর দলের সত্যিকারের নির্দেশ প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন।” সিপিএমের রবীন দেবও কার্যত একই মন্তব্য করেছেন। কমিশন বীরভূম জেলাশাসকের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে।
এ দিন অনুব্রতবাবু অবশ্য দাবি করেন, “অন্য কাউকে মনোনয়ন দিতে দেব না, এমন কথা আমি বলিনি। আমার কথার অপপ্রচার হয়েছে।” দলও যে আপাতত তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না তা কার্যত পরিষ্কার করে দিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের দাবি, “অনুব্রত ও কথা বলতে চায়নি। ওর কথার অভিব্যক্তিতে কোনও সমস্যা হয়েছে।” |
মঙ্গলকোটের সারঙ্গপুরে পোড়া তৃণমূল কার্যালয়। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় |
বিরোধীদের অভিযোগ, অনুব্রতবাবুর ওই কথা জায়গায় জায়গায় তৃণমূল কর্মীদের হিংসার ইন্ধন জুগিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, দুই ২৪ পরগনা ও হুগলিতে তাদের সমর্থকদের উপরে চড়াও হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে কংগ্রেস। চারটি বামপন্থী কৃষক সংগঠনের বৈঠকের পরে সিপিএম নেতা মদন ঘোষ দাবি করেন, “জনবিচ্ছিন্নতার কারণেই তৃণমূল এ ভাবে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে।”
ঘটনা হল, এ দিনই বর্ধমানের বড়শূলে মনোনয়ন দিতে যাওয়ার সময়ে সিপিএমের বাস ও মিনি ট্রাক আটকে আগ্নেয়োস্ত্র, টাঙ্গি, লাঠি-সহ ১৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আবেদ আলি নামে সিপিএমের এক প্রাক্তন লোকাল সম্পাদকের কাছ থেকেও দুটি নাইন এমএম পিস্তল ও ১৭ রাউন্ড গুলি বাজেয়াপ্ত করা হয়। মুকুলবাবুর প্রতিক্রিয়া, “ওঁরা নিজেরা এই ভাবে অস্ত্র নিয়ে মনোনয়ন জমা দিতে যাচ্ছেন আর হাইকোর্ট-কমিশনে গিয়ে বলছেন, মনোনয়ন দিতে পারছি না!” সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অবশ্য দাবি করেন, “মহিলাদের নিরাপত্তা দিতেই আদিবাসীরা অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন।”
এ দিনই বর্ধমানের শক্তিগড়ের কাছে তৃণমূল কার্যালয়ে তাণ্ডব চালানো হয়। সামাল দিতে গিয়ে জখম হয়েছেন পুলিশের এক এএসআই। সিপিএম কার্যালয়ে তল্লাশি চালাতে গিয়ে নর্দমায় প্লাস্টিকে জড়ানো ১২টি তাজা বোমাও পেয়েছে পুলিশ। যে পশ্চিম মঙ্গলকোটে গত দু’বছর পার্টি অফিস খুলতে পারেনি সিপিএম, রবিবার রাতে সেখানেই নতুনহাট-গুসকরা রাস্তায় তৃণমূলের দু’টি কার্যালয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। দলেরই একাংশের মদতে সিপিএম এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তৃণমূলের এক গোষ্ঠীর অভিযোগ। এ দিনই সকালে প্রায় গোপনে কাটোয়ায় মহকুমাশাসকের দফতরে গিয়ে মঙ্গলকোটের বিভিন্ন গ্রামের সিপিএম এবং কংগ্রেস প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।
হাওড়ার উলুবেড়িয়ায় দুই মহিলা প্রার্থীকে মারধর ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। বামেদের দখলে থাকা জুয়ারগড়ি পঞ্চায়েতে শনিবার গভীর রাতে ওই মহিলাদের ঘরও ভাঙচুর করা হয়। ওই ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ দিন বিকেলে আবার উলুবেড়িয়ারই করাতবেড়িয়ায় তৃণমূলের এক মহিলা কর্মীকে মারধর ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে সিপিএম এবং ফব-র বিরুদ্ধে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জে আবার কংগ্রেস কর্মীদের সিপিএম সমর্থকেরা চড়াও হয় বলে অভিযোগ। এক পুলিশকর্মী-সহ উভয় দলের ১৪ জন জখম হয়েছেন। তবে বামেরা অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বাকি সব জায়গাতেই অবশ্য সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধেই। অনুব্রতবাবুর বীরভূমেই ঘটেছে বেশ কয়েকটি ঘটনা। সকালে সাঁইথিয়ার আমোদপুরে মনোনয়ন দিতে গিয়ে মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি কংগ্রেসের এক পঞ্চায়েত প্রধান-সহ তিন জন। লাভপুরে মার খান বিজেপি-র জেলা সম্পাদক কাশীনাথ মিশ্র। বোলপুর ও ইলামবাজারেও আক্রান্ত বিজেপির চার প্রার্থী। মহম্মদবাজারে মনোনয়নপত্র তুলতে গেলে সিপিএম কর্মীদের মারধর করে মনোনয়নপত্র ছিঁড়ে দেওয়া হয়।
এ দিন মেদিনীপুর ব্লক অফিসের সামনে তৃণমূলের জমায়েত ও কংগ্রেস প্রার্থীদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ পেয়ে ছবি তুলতে মারধর করা হয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের। এবিপি আনন্দের চিত্র-সাংবাদিক বিল্টু গোপ-সহ তিন জন পুলিশের সামনেই মার খান। জেলা পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী পরে বলেন, “সাংবাদিকদের উপর হামলার অভিযোগ পেয়েছি। উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হচ্ছে।” অন্য দিকে, দলীয় প্রার্থীদের মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ তুলে পিংলা ব্লক অফিসে অবস্থানে বসেন কংগ্রেস নেতারা। দাসপুরে সিপিএম প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র ছিঁড়ে দেওয়া এবং শালবনিতে সিপিআই ও সিপিএম কর্মীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে। মেদিনীপুর সদরে মার খান বিজেপি-র নেতা-কর্মীরাও। মনোনয়ন জমা দিয়ে ফেরার পথে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীতে আক্রান্ত হন আরএসপি প্রার্থীরা। আহত হয়েছেন ছ’জন।
হাওড়ার আমতা-২ ব্লকে কংগ্রেস এবং হুগলির আরামবাগে সিপিএম প্রার্থীদের মেরে তাড়ানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। রাতে সিপিএমের আরামবাগ জোনাল অফিসের দেওয়ালে পরপর বেশ কিছু বোমা পড়ে। সব ক্ষেত্রেই অবশ্য তৃণমূল অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মুকুলবাবু বলেন, “বিরোধীদের এক জন প্রার্থীও যদি মনোনয়ন পেশে বাধা পান আমাদের জানান। আমরা ব্যবস্থা করে দেব।”
|