বীণা মজুমদার নিজেকে বলতেন এশীয় মানবীবিদ্যাচর্চার ‘গ্র্যান্ডমাদার’।
সাম্য-সংগ্রাম, শিখ দাঙ্গা, মানবীবিদ্যাকেন্দ্রের স্বীকৃতি: সকল প্রতিবাদের
সামনের মুখ ছিলেন এই লেখক, সম্পাদক ও স্বঘোষিত নারীবাদী। আজীবন।
শাশ্বতী ঘোষ |
বীণা মজুমদার (জন্ম ১৯২৭), সকলের ‘বীণাদি’, চলে গেলেন গত ৩০ মে ২০১৩ তারিখে সকালবেলাতেই। দাপটের এক জীবন, যেখানে ইস্কুলে ভর্তি হবার সময়ে মা বলে দিয়েছিলেন, ‘পড়ার সুযোগ পাচ্ছ, ঘর-বর-সংসার করে তাকে অপব্যবহার কোরো না, আমরা কেউ কিন্তু এই সুযোগ পাইনি।’ ভারতের মেয়েদের অবস্থান নিয়ে অন্যতম দলিল ‘টুয়ার্ডস্ ইকুয়ালিটি’ রিপোর্ট বা নারীবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র নয়া দিল্লির ‘সেন্টার ফর উইমেন্স ডেভলপমেন্ট স্টাডিস’ তৈরি করা বা শিক্ষা হোক বা নারী আন্দোলন, তা নিয়ে অন্তহীন গবেষণা বিশিষ্ট হয়েও তিনি ছিলেন একান্ত কাছের।
বীণাদি কলকাতার মেয়ে, ডায়োসেশন স্কুল, উইমেন্স কলেজ, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে আবার আশুতোষ কলেজ। তার পর ১৯৫১ সালে স্নাতক ডিগ্রির জন্য অক্সফোর্ডে পাড়ি। আবার ১৯৬০ সালে অক্সফোর্ডে ফেরা ডি ফিল ১৯৬২-তে। এর মধ্যে পটনা আর ব্রহ্মপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ানো। জাতীয়তাবাদী ভাবনা তো ছিলই, তাই কলেজের মেয়েদের নিয়ে গাঁধীকে দেখতে সোদপুর যাওয়া বা ১৪ অগস্টের মধ্যরাত্রে নেহরুর বক্তব্য শুনতে শুনতে পতাকা বদল দেখা, নতুন ভারতের জন্য এক উদ্দীপ্ত বিশ্বাসের প্রজন্মের প্রতিনিধি তিনি। |
১৯৭১ সালে তৈরি হয়েছে ‘স্টেটাস অব উইমেন কমিটি’। রাষ্ট্রপুঞ্জের নারীবর্ষে (১৯৭৫) ভারতের মেয়েদের অবস্থান নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। ফুলরেণু গুহের নেতৃত্বে কাজ করবেন বীণা মজুমদার, লতিকা সরকার, কুমুদ শর্মা আর ঊর্মিলা হাকসার। মাঝপথে বীণাদি মেম্বার সেক্রেটারি নিযুক্ত হলেন। ছোট্ট ফ্ল্যাট, টাকাপয়সা কম, বাড়িতে বয়ঃসন্ধির বিদ্রোহী মেয়েরা আত্মজীবনী ‘মেমরিস অব এ রোলিং স্টোন’-এ (জুবান, ২০১০) লিখছেন, তেরো বছরে বারোটা চাকরি! ‘টুয়ার্ডস্ ইকুয়ালিটি’ রিপোর্ট-এর ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আলোচনাচক্রে স্মৃতিচারণ করেছেন: তাঁদের টার্মস্ অব রেফারেন্স-এ বলা হয়েছিল, স্বাধীনতার পরে কাজের ক্ষেত্রে মেয়েদের সুযোগ ও মজুরি কেন যথেষ্ট বাড়ছে না, এবং গৃহবধূ ও মায়েরা কেন শিক্ষায় এগোতে পারছেন না, তা নির্ণয় করতে হবে। রাজনীতির প্রশ্ন কোথাও আনা হয়নি, অথচ বলা হল জাতি গঠনে মেয়েরা তাঁদের সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার কী করে দেখাতে পারেন, তার পথ দেখাতে। শিক্ষার সুযোগের অসমতার কথা ছিল, কিন্তু সেই সময় সবে ১৯৭১-এর জনগণনার তথ্য এসেছে, দেখা গেছে নারী সাক্ষরতার হার মাত্র ১৮.৪%, তবু নিরক্ষরতার প্রশ্নটি তাঁদের দেখতে বলা হয়নি; দেখতে বলা হয়নি স্বাস্থ্যের প্রশ্নটিও, শুধু বলা হয়েছিল জনসংখ্যা ও পরিবার পরিকল্পনা নীতির প্রেক্ষিতে মেয়েদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি দেখতে। এরই মধ্যে অবশ্য তাঁদের নিজের মতো করে অনুসন্ধানের পরিসর রাখা হয়েছিল, তার জন্য তিনি কোনও দূরদর্শী আমলারই প্রশংসা করেছেন।
তো, ভারতের সমস্ত রাজ্যে তাঁরা ঘুরলেন, মেয়েদের সঙ্গে সভা করলেন, কথা বললেন ১০,০০০ মেয়ের সঙ্গে। কমিটি তৈরির সময় ভারত সরকারের আমলাদের ধারণা ছিল, শহুরে মেয়েরা বৈষম্য অনুভব করেন না, তাঁরা সংবিধানের সমানাধিকারের সুযোগ পেয়েছেন, যা সমস্যা সব আসলে গ্রামের মেয়েদের। কোন পথ নিতে বলা হবে সরকারকে, যাতে মেয়েরা পূর্ণ নাগরিক হয়ে উঠতে পারেন? সংরক্ষণ? তা নিয়ে মতদ্বৈধ। রিপোর্ট তৈরি হল, সরকারি ব্যবস্থা, সংবিধানের প্রতিশ্রুতি সাধারণ মেয়েদের অধরা রয়ে গেছে সরকারের এত বড় সমালোচনা বোঝার আগেই তা উপস্থিত করা হল লোকসভায়। গৃহীত হল। তার পর এল জরুরি অবস্থা।
মেয়েদের এই অবস্থাটা দেখে আবার ঘরে ফিরে নিজের কাজে লেগে যাবেন কী করে? জরুরি অবস্থার জুজু। তাই ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব সোশাল সায়েন্স রিসার্চ’-এর নারী বিষয়ক গবেষণা কমিটির দায়িত্ব সামলাতে চলে এলেন বীণাদি। কাউন্সিলের সে সময়ের সেক্রেটারি, অধ্যাপক জে পি নায়েকের সঙ্গে আলোচনার কথা লিখছেন তিনি এখন আর কোনও কিছু বোধহয় করা যাবে না, মেয়েদের বিষয়ে (গবেষণার) রাজনৈতিক তাৎপর্যটা এখনকার ক্ষমতাসীনরা এখুনি বোধহয় বুঝবে না।
১৯৮০ সালে তৈরি করলেন নয়া দিল্লির ‘সেন্টার ফর উইমেন্স ডেভলপমেন্ট স্টাডিস’। শুধু গবেষণা নয়, তৃণমূলের গরিব মেয়েদের কাছ থেকে, তাঁদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকা থেকে শিক্ষা নেবেন গবেষকরা। তাই বাঁকুড়ার ঝিলিমিলিতে তৈরি হল কেন্দ্র, গ্রামের মেয়েদের মধ্যে তাঁদের আনাগোনা। সেই সঙ্গে তৈরি করলেন নারী বিষয়ক গবেষকের সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন্স স্টাডিস’: বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোয় আর গবেষণায় মেয়েদের জন্য পরিসর আর দেখার চোখ তৈরি। মানবীবিদ্যাচর্চা আর নারী আন্দোলন, নারী সংগঠনের আন্তঃসম্পর্কটি কী হবে, তার সন্ধানও চালিয়েছেন আজীবন।
বীণাদি নিজেকে বলতেন স্বাধীনতা আন্দোলনের ফসল, সংবিধানে সমতার সুযোগ ভোগকারীদের প্রথম প্রজন্ম। নিজেকে নারীবাদী বলতে কোনও দ্বিধা ছিল না। তাঁর প্রজন্মের অন্য অনেকেই, ঊষা মেটা, মৃণাল গোরে বা সুশীলা গোপালন নারী সমতার আন্দোলনে অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত থেকেও কেন নিজেদের নারীবাদী বলেন না? তাঁর মতে, তাঁরা নিজেদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ফসল বলে ভাবতে শিখেছেন, আর শিখেছেন, নিজেরা বৈষম্যের শিকার না হলে কেউ নারীবাদী হয় না। তিনি নিজে হাড়ে হাড়ে বৈষম্য অনুভব না করলেও দেশের মেয়েরা যে বৈষম্যের শিকার তা জেনেছেন। তা হলে তাঁর নিজেকে নারীবাদী বলতে আটকাচ্ছে কোথায়? বলেছেন বিধবা পিসিমার কথা সুযোগ না-পাওয়া সেই মানুষটির আগ্রহেই বাড়ির মেয়েরা পড়তে পেরেছে। মানবীবিদ্যাচর্চায় আগ্রহীদের বলেছেন আগে তোমার ঠাকুমার সঙ্গে কথা বলো, দেখো কেমন জীবন তাঁরা যাপন করতেন।
বই লেখা, সম্পাদনা করা, চার সন্তানকে বড় করা; এ সব কিছুর সঙ্গে সঙ্গে শিখ দাঙ্গা হোক বা মানবীবিদ্যা কেন্দ্রগুলিকে পারিবারিক মূল্যবোধ প্রসারকেন্দ্র করে তোলার সরকারি প্রস্তাব সমস্ত প্রতিবাদের সামনের সারিতে বীণাদি। মথুরা ধর্ষণ মামলার পুনর্বিচার চেয়ে ১৯৭৯ সালে প্রধান বিচারপতিকে লেখা সেই ঐতিহাসিক খোলা চিঠির অন্যতম স্বাক্ষরকারী লতিকা সরকার, উপেন্দ্র বকশী, বসুধা ধাগম্বরের সঙ্গে। প্রসঙ্গত, ভারতের নারী সমতা ভাবনার আর এক দিকপাল লতিকা সরকার, চলে গেলেন গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ তারিখে।
এশিয়ার মানবীবিদ্যাচর্চার দিদিমা (গ্র্যান্ডমাদার) বলতেন বীণাদি নিজেকে। চলে গেলেন, সমতার দিকে অনেকটা এগিয়ে দিয়ে। |