আমরা-বাঙালির রাজত্বে কিছু বেয়াড়া ওরা-বাঙালি আগেও ছিলেন, এখনও আছেন।
ক্ষমতা তাঁদের শিরদাঁড়া নোয়াতে পারে না, ফলে তাঁরা ওরা-ই থেকে যান। লিখছেন
বাসব চৌধুরী |
চিন্ময় গুহ (‘কে ঠেকাবে ‘আমরা’-র দাপট?’, ২৩-৫) আমরা-ওরা বিভাজনের কথা বলেছেন, কিন্তু পরিস্থিতি নির্বিশেষে শুধু আমরা বা শুধু ওরা-র কথা বলেননি। ওরা থেকে আমরা-তে রূপান্তরের ব্যাপারেও তিনি নীরব থেকেছেন। পরিস্থিতির অদলবদল হলেও যাঁরা আমরা হয়েই থাকেন, তাঁরা পাকা খেলুড়ে। বাম জমানায় মতাদর্শগত ভাবে বামপন্থী হলেও পশ্চিমবঙ্গের স্পেশাল জো-হুজুর বামপন্থার সঙ্গে যাঁরা মানিয়ে নিতে পারেননি, অনেক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কিন্তু ওরা-ই ছিলেন। সাধারণ ভাবে তাঁদের বামবিরোধী বলা না হলেও তাঁরা ঠিক আমরা হতে পারেননি, ক্ষমতার বৃত্তেও তাঁদের স্থান হয়নি। দৈবাৎ ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হলেও অল্প সময়েই তাঁরা বসের লালচোখের শিকার হয়েছেন। তাঁদের সম্পর্কে পরিকল্পিত ভাবে চিরকালীন আমরা-রা অজস্র মিথ্যা কথা বাজারে প্রচার করেছেন, যাতে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করা যায়। বর্তমানেও এমন যোগ্যতাসম্পন্ন, নীতিনিষ্ঠ, প্রকৃত মেরুদণ্ডওয়ালা মানুষদের সিপিএম অভিধায় ভূষিত করে হেনস্থা করা হচ্ছে। এঁরাই কিন্তু প্রকৃত ওরা। এর বিপরীতে যাঁরা, তাঁরা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব রাজনৈতিক ঋতুতেই আমরা এবং ‘কাজে-কাজেই, অতএব, সুতরাং, যেহেতু, কিন্তু’ ক্ষমতার মহাপ্রসাদ চেটেপুটে সাফ করবার অধিকারী। |
শিক্ষাজগৎকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, সেই সূত্রে ওরা-দের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যের কথা বলি। কর্মজীবন যতই উপসংহারের দিকে এগিয়ে চলে, ততই ওরা-দের আমরা-তে রূপান্তরের প্রবণতা দেখি। এই রূপান্তরে অনুঘটক হিসেবে যা কাজ করে, তা হল, চাকরিতে এক্সটেনশন অথবা দ্বিতীয় বা তৃতীয় দফায় পদপ্রাপ্তি, অথবা নিয়মকে পাশ কাটিয়ে অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট-এর ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি। চেষ্টা করেও যাঁরা ওরা থেকে আমরা হতে পারেন না, তাঁরা বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ ভিজে শালিকের মতো বিবর্ণ হয়ে যান। তাঁদের ভগ্ন হৃদয় কোনও ভাবেই ঢেকে রাখা যায় না। এর বাইরে আর এক ধরনের ওরা আছেন, যাঁরা সংখ্যায় বড় কম, কিন্তু খানিকটা বলিষ্ঠ ওরা। এই ওরা-দের কেউ কখনও পছন্দ করেন না, কারণ এঁরা সরকারি নিয়মকানুন মেনে কাজ করতে ভালবাসেন, ব্যক্তির বদলে প্রতিষ্ঠানকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, কত্তা বা গিন্নির সামনে হেঁ-হেঁ করে হাত কচলাতে পারেন না, নিজেরা কর্মক্ষেত্রে কোনও বিশেষ সুযোগ চান না এবং সর্বদা আশা করেন, প্রতিষ্ঠানের আর সকলে ন্যায়নীতি, নিয়মকানুন মেনে চলবেন, ইন্টিগ্রিটি কথাটার মর্যাদা দেবেন। এই ওরা-রা সত্যিকারের হতচ্ছাড়া। এদের গিলতেও পারা যায় না, ফেলতেও পারা যায় না। সব যুগেই এই ওরা-রা ‘চিরন্তন-রূপান্তরিত অথবা রূপান্তরে-আগ্রহী’ আমরা-দের চক্ষুশূল।
চিন্ময়বাবু লিখেছেন, বোঝার সময় এসেছে আমাদের দুটি চোখ, একটি নয়। কিন্তু দু’চোখেই যদি ঠুলি পরা থাকে? আর বাঙালির খারাপ অসুখটা তো আড়াইশো বছরেরও বেশি পুরনো। এ অসুখের চরিত্রটি হল আমরা-বাঙালির মনে একই সঙ্গে প্রভু এবং ভৃত্যের প্রবল ও প্রগাঢ় উপস্থিতি (অথবা স্বাস্থ্যকর সহাবস্থান)। আমরা-বাঙালি অনায়াসে উপরওয়ালার বশংবদ, সুতরাং প্রিয়পাত্র; আবার বশংবদরা যখন প্রভুর আসনে বসেন, তখন আশা করেন তাঁর অধীনস্থরাও হবেন দাসানুদাস। এর বিপরীতে বেয়াড়া ওরা-রা আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চান, দয়াদাক্ষিণ্য বিশেষ চান না, হাত কচলাতে তাঁদের ইচ্ছে করে না এবং অধীনস্থদের তাঁরা যথোচিত মানবিক সম্মান প্রদান করতে কুণ্ঠিত হন না। ফলত, বাম-ডান-মাঝখান যেখানেই যান, ওরা-রা মুর্দাবাদ। আমরা চাবুক চালাই, ওরা দূর হয়ে যায়। |