প্রবন্ধ ১...
মুখোশের আড়ালে আসল মোদী কে?
রেন্দ্র মোদী কে? ‘হিন্দুত্বের পোস্টারবয়’ এই পরিচয়ে এখন তাঁকে ধরতে যাওয়া মুশকিল। সেটা ২০০২ সালের পরিচয়। তখন তাঁর উগ্র হিন্দুত্ববাদী পরিচয় প্রয়োজন ছিল। ১৯৯৫ থেকে ২০০২ পর্যন্ত গুজরাতে বিজেপি টালমাটাল অবস্থায় ছিল। তখন রাজ্য শাখা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল দিল্লির সদর দফতর থেকে। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে মুখ বদলাচ্ছিল ঘন ঘন। ফলে, কেশুভাই পটেলকে সরিয়ে ২০০১ সালে যখন দিল্লি থেকে মোদীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল আমদাবাদে, তখন মোদী জানতেন, তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের মেয়াদ নির্ভর করছে দিল্লির এবং অবশ্যই নাগপুরের ওপর। সেই আস্থা অর্জনের, এবং পাশাপাশি গুজরাতের জনতার মনে নিজের পরিচয় গড়ে তোলার সবচেয়ে সহজ রাস্তাটাই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ সেই রাস্তার নামঠিকানা জানে।
সেই পরিচয়ের প্রয়োজন তাঁর ফুরিয়েছে। এখন তিনি শুধু গুজরাতের রঙ্গমঞ্চের অবিসংবাদী নায়কের ভূমিকায় সন্তুষ্ট নন, তাঁর চোখ দিল্লির মসনদের দিকে। এই ময়দানে তাঁর নতুন পরিচয় চাই। তারও আগে চাই পুরনো পরিচয়ের বোঝা ঝেড়ে ফেলা। একুশ শতকের ভারতে অযোধ্যা অতীত, উগ্র সংখ্যালঘু বিরোধিতা দিয়ে ভোটের ময়দান পার করা যাবে না আর। অতএব, ‘লৌহপুরুষ’ মোদী, তাঁর মার্কিন জনসংযোগ সংস্থা এবং ভারতীয় সহকারীদের সহায়তায়, মোড়ক বদলে হয়ে ওঠেন ‘বিকাশপুরুষ’। তার পুরনো সঙ্গীরা তাতে বিলক্ষণ চটেছেন। যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ আর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ২০০২ সালে জান লড়িয়ে দিয়েছিল তাঁকে জিতিয়ে আনার জন্য, পাঁচ বছর পরে তারাই বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে মাঠেই নামেনি বহু দিন পর্যন্ত। সরসংঘচালক মোহনরাও ভাগবত মোদীকে যতটা অপছন্দ করা সম্ভব, ততটাই করেন।
একা ও কয়েক জন। নরেন্দ্র মোদীর মুখোশ পরে সমর্থকরা।
‘নতুন’ মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ামাত্র দেশে সংখ্যালঘু নিধন আরম্ভ হবে, সে সম্ভাবনা কার্যত নেই। মোদীর হৃদয় পরিবর্তিত হয়েছে বলে নয় গুজরাতে তাঁর শাসনে মুসলমানরা সচেতন ভাবেই ব্রাত্য তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়া এবং সেই পদে টিকে থাকার সঙ্গে উগ্র হিন্দুত্বের বিরোধ আছে বলে। ফের প্রয়োজন হলে তিনি উগ্র হিন্দুত্বে ফিরবেন, অনুমান করা চলে। আসলে মোদী ঠিক এই রকমই যখন যে পরিচয়ে তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে, তিনি তখন সেই পরিচয়েই থাকবেন। গুজরাতের একটা ছবি খুব দেখা যায় অজস্র মানুষ মোদীর মুখোশ পরে আছেন। ছবিটা প্রতীকী। মুখোশের আড়ালে মোদীর আসল মুখটা কী রকম, কেউ জানে না। শুধু একটি জিনিসই অপরিবর্তিত ২০০২ সালের মুসলিম-নিধনের সময় তিনি অগণতান্ত্রিক ছিলেন, আজও আছেন। গণতন্ত্র তাঁর লক্ষ্য নয়।
তাঁকে নিয়ে এন ডি এ-র ভিতর, এমনকী বিজেপি-র অভ্যন্তরেও অস্বস্তি বিপুল। নীতীশ কুমার কার্যত বলে দিয়েছেন, মোদী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হলে তিনি জোট ছাড়বেন। শিবসেনার মুখপত্রে সুষমা স্বরাজকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর ভূমিকায় দেখতে চাওয়া হয়েছে। বিজেপি-র ভিতরেও এক অরুণ জেটলি ছাড়া তাঁর পাশে দাঁড়ানোর মতো প্রথম সারির নেতা নেই বললেই চলে। আডবাণী এখনও হাল ছাড়েননি, সুষমা স্বরাজ তাঁর পাশে। বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহও মোদীপন্থী হিসেবে পরিচিত নন।
বস্তুত, মোদীর প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘ পরিবার-বিজেপির সম্পর্ক একটা নতুন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এমনিতে সংঘ পরিবারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরোনোর জন্য বিজেপির আকুলতা, এবং নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে না চাওয়ায় সংঘের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। বাজপেয়ী থেকে আডবাণী, বিজেপি-র শীর্ষনেতৃত্বের সঙ্গে সংঘের সম্পর্ক, সেই নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নেই, নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর উপাখ্যান এঁদের চেয়েও বিচিত্র। মোদী নাগপুরের নিয়ন্ত্রণ মানতে নারাজ তো বটেই, দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণেরও ধার ধারেন না। দলের সব বড় মাপের নেতার যেখানে তাঁকে নিয়ে অস্বস্তি প্রকট, সেখানে কার্যত নিজেকে নিজে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে দেওয়া এবং দলকে সেই ঘোষণার সঙ্গে তাল রাখতে বাধ্য করার দৃষ্টান্ত বিজেপি-তে এই প্রথম। ২০১৪ যদি মোদীর জন্য সুসংবাদ বয়ে আনে, সংঘ পরিবারের সঙ্গে বিজেপি-র সম্পর্ক আনকোরা নতুন মোড় নেবেই।
কীসের ভরসায় এই একার দৌড়ে নেমেছেন মোদী? না, তাঁর দৌড় একার নয়। তাঁর সঙ্গে যাঁরা দৌড়োচ্ছেন, তাঁরা একুশ শতকের প্রযুক্তিবিদ। ভারতে এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১৪ কোটি মানুষ। মোদীর সহযোদ্ধারা ধরে ফেলার চেষ্টা করছেন এই ১৪ কোটিকেই মোদীকে তাঁদের পছন্দসই মোড়কে তাঁদের কাছে উপস্থিত করে। সংখ্যাটা বেশ বড় ২০০৯ সালে কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিলেন ১১ কোটি মানুষ। কাজেই, এই ১৪ কোটির একটা অংশের মন জেতা গেলেও অনেক। মোদীর হয়ে বহু ওয়েবসাইট এই কাজে নিয়োজিত। তাদেরই একটা লিখেছে, ভারতে মোট যত মানুষ ভোট দেন, তাঁদের মাত্র পাঁচ শতাংশকে টানা গেলেই ভোটের হিসেব সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে। মোদী, এবং তাঁর প্রযুক্তিবিদ সহায়করা এই পাঁচ শতাংশের মন জয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন।
যে পথে এই চেষ্টা হচ্ছে, সেটাও ভারতে ভয়ানক রকম নতুন। এই পাঁচ শতাংশের মধ্যে সংখ্যালঘু প্রীতি তীব্র নয়। কিন্তু জয় ভগবান গোয়েলের মতো বিশ শতকের হিন্দুত্ব দিয়ে এঁদের কাছে টানা যাবে না। এঁদের উন্নয়নের গল্প বলতেই হবে। মোদীর জনসংযোগ সংস্থা সাতকাহন করে তাঁর ‘উন্নয়নের’ গল্প ছড়িয়ে দিচ্ছে মিডিয়ায়। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেই যে ভারত বদলে যাবে রাতারাতি, দশ শতাংশ বৃদ্ধির হার হবে ন্যূনতম, বিশ্বাস করতে বলছে তারা। সেই গল্পে যাদের বিশ্বাস করার, তারা করছে, ফের ছড়িয়ে দিচ্ছে স্যোশাল মিডিয়ায়।
কিন্তু, মোদী যে পথে হাঁটতে অভ্যস্ত, সে পথে উন্নয়ন কোথায়? উন্নয়ন যে শুধু ৫০০০ কোটি টাকার মেগা প্রজেক্ট নয়, প্রচারযজ্ঞের ঢাকের আওয়াজে অর্থনীতির এই প্রাথমিক পাঠটুকুও গুলিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। তাতে অবশ্য বাস্তব ঢাকা পড়ে না। মোদীর গুজরাতেই তাঁর উন্নয়নের মডেল নিয়ে প্রশ্ন প্রচুর। অভিযোগ উঠেছে, তাঁর রাজ্যে পরিকাঠামো তৈরি হয় শুধুমাত্র শিল্পপতিদের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে। তার জন্য যদি মুছে ফেলতে হয় বিস্তীর্ণ জনবসতি, তা-ও সই।
মোদীর জনসংযোগ সংস্থা নিপুণ ভাবে প্রচার করে গিয়েছে, গুজরাতে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। আসলে, প্রবল রকম আছে। পশ্চিমবঙ্গে হাজার একর জমি না পেয়ে টাটা ন্যানোর কারখানা যখন গুজরাতের সানন্দে পৌঁছেছিল, তার জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছিল ৫০০০ একর। ২০০০ কৃষক প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁরা জমি দিতে চাননি। ২০১২ সালের অগস্টে ভদোদরা এবং সংলগ্ন ভারুচ জেলার ৬০টি গ্রামের কৃষক প্রতিবাদে নেমেছিলেন। তাঁদের অভিযোগ, গুজরাত ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন অতি সামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়েই জমি দখল করে নিচ্ছে। ২০১৩-র মার্চে ভদোদরার সাওলি অঞ্চলে বিপুল প্রতিবাদ হয়েছিল। অভিযোগের তির সেই জিআইডিসি-এর দিকেই। স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন অ্যাক্ট-এ নির্বিচারে কৃষি জমি অধিগ্রহণ নিয়েও আন্দোলন হয়েছে। উপকূলবর্তী মুন্দ্রা অঞ্চলে আদানি ও টাটা গোষ্ঠীর শিল্প, বন্দর এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবাদ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রতিবাদের আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। কিন্তু মূল কথাটি পরিষ্কার মোদীর মডেল তাঁর খাসতালুকেও সর্বজনস্বীকৃত নয়।
নরেন্দ্র মোদী সেই আন্দোলনকে পাত্তা দেননি। মহুয়ায় নিরমা-র সিমেন্ট কারখানা পরিবেশের বিপুল ক্ষতি করবে, সেটা জানার পরও এক চুল সরেননি নিজের সিদ্ধান্ত থেকে। ভাবনগরে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদেও উচ্চবাচ্য করেননি। অভিযোগ উঠেছে, জিআইডিসি ১৯৮০-র দশকে যে জমি অধিগ্রহণ করেছিল সরকারি প্রয়োজনের কথা বলে, সেই জমিই এখন জলের দরে দেওয়া হচ্ছে মোদী-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের। অভিযোগ উঠেছে, তাঁর আমলে যত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়পত্র পেয়েছে, তার অনেকগুলিতেই শেষ পর্যন্ত শিল্প তৈরি হয়নি কিন্তু জমি রয়ে গিয়েছে বিনিয়োগকারীদের হাতেই। মোদী কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দেন না।
কোনও প্রতিবাদকেই পাত্তা না দেওয়া, কৃষি থেকে পরিবেশ, স্থানীয় মানুষদের জীবন-জীবিকা কোনওটিকেই গুরুত্বপূর্ণ না ভাবাই মোদীর স্টাইল। নির্মিত, নিঃসন্দেহে মোদী জানাতে চান, শিল্পায়নের পথে কোনও বাধার সামনেই নতিস্বীকার করতে রাজি নন তিনি। শিল্পায়নের স্বার্থে তিনি নির্মম, সমস্ত গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলতেও বিন্দুমাত্র বাধে না তাঁর। শিল্পায়নের জন্য একনায়ক হতেও তিনি রাজি।
এই যে একবগ্গা শিল্পায়নের ঘোড়া ছোটানো, এটাকেই উন্নয়ন বলে চালানোর মধ্যে একটা চরম অন্যায় রয়েছে। সত্যগোপনের অন্যায়। মোদীর শাসনকালে রাজ্যে আর্থিক অসাম্য বেড়েছে, হিন্দু-মুসলমানের ভোগব্যয়ের ফারাক বেড়েছে, তফশিলি জনজাতির সঙ্গে অন্যান্য শ্রেণির আয়বৃদ্ধির হারের ফারাক আরও দৃষ্টিকটু হয়েছে। তুমুল আয়বৃদ্ধি সত্ত্বেও স্বাস্থ্যের বিভিন্ন মাপকাঠিতে গুজরাত বড় জোর জাতীয় গড়ের কাছাকাছি। পরিবেশের প্রশ্নটি মোটে গুরুত্বই পায়নি। মোদীর জনসংযোগ সংস্থা যতই শিল্পায়নের চোখধাঁধানো গল্প বলে চলুক, উন্নয়নের এই মাপকাঠিগুলোকে সচেতন ভাবে অবহেলা করা চরম অন্যায়।
মোদী ভারতীয় রাজনীতিতে বহু নতুন জিনিস আমদানি করেছেন। কিন্তু সবচেয়ে নতুন এই নিজের অগণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির প্রকট বিজ্ঞাপনসহ ভোটের ময়দানে অবতীর্ণ হওয়া। ভারতে এর আগে এক জনই গণতন্ত্রের পথ থেকে চ্যুত হয়েছিলেন। জরুরি অবস্থা-উত্তর ইন্দিরা গাঁধীকে তার বিপুল খেসারতও দিতে হয়েছিল। তার পরের চার দশকে কেউ প্রকাশ্যে অগণতান্ত্রিক হওয়ার সাহস দেখাননি।
মোদী দেখাচ্ছেন শুধু নয়, সেই পরিচয়েই ভোট চাইতে বেরিয়েছেন। তিনি যে পাঁচ শতাংশ ভোটারকে ধরতে উদ্গ্রীব, তাঁরা কি এই অগণতান্ত্রিক শাসককেই স্বীকার করে নেবেন? নাকি তাঁরা দেখতে পাবেন, উন্নয়নের নামে আসলে কিছু লোকের লাভের বহর বেড়েই চলেছে, আর অনেকের জীবন ক্রমে কঠিনতর হচ্ছে? আজ গুজরাতে মোদীর উন্নয়নের মডেলের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হচ্ছে, গোটা দেশ জুড়েই ছড়িয়ে পড়বে তা? আটকে যাবে মোদীর একদর্শী অগণতান্ত্রিক কর্পোরেট উন্নয়নের ঘোড়া?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.