দশ নম্বর আলিপুর রোডে গত বৃহস্পতিবার সকালে আর পাঁচটা দিনের সঙ্গে তফাত বলতে ছিল একটা কেকের আবির্ভাব। কেক কাটা হয় গৃহস্বামীর বাহাত্তরতম জন্মদিন পালন করতে। এবিপি আনন্দে ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রয়াণের শোকবিহ্বল ছবি দেখতে দেখতে কিছুটা বিষণ্ণ জগমোহন ডালমিয়া যখন কেকটা কাটেন, তখন তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি, বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে এ রকম একটা জন্মদিনের উপহার তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। ফিনিক্স পাখির মতো প্রায় ভস্ম হয়ে যাওয়া অবস্থা থেকে তাঁর আবির্ভাব ভারতীয় ক্রিকেটের মগডালে। তাঁর হাতেই যে সমাধানসূত্র থাকতে পারে, সেটা আনন্দবাজারেই রবিবার বেরোয়।
বাংলা ক্রিকেটীয় কামব্যাক একাধিক বার দেখেছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামক এক ব্যক্তির কল্যাণে। কিন্তু ক্রিকেট প্রশাসনে এত বড় কামব্যাক দেখেনি। পাঁচ বছর আগে যে বোর্ড শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে ২৯-০ ভোটে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল, তাঁকে আর্থিক তছরুপে অভিযুক্ত করে ফৌজদারি মামলা করেছিল, সেই বোর্ডই কি না অস্থায়ী বোর্ড প্রেসিডেন্টের মুকুট পরিয়ে দিল! পদের মেয়াদ কত দিন কেউ জানেন না। অন্তর্বর্তিকালীন সভাপতি এই হল তাঁর পদ। যেখানে ডালমিয়ার আবাহন ঘটল বিপুল বিতর্কের মধ্যে দিয়ে। আইএস বিন্দ্রা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, ডালমিয়ার মনোনয়নে তাঁর তীব্র আপত্তি আছে। বললেন, এই সভাই অবৈধ। এই নিয়ে তিনি আইনি হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন।
আর ক্রিকেট-পৃথিবীর একটা বড় অংশ বলল, পর্বতের মূষিক প্রসব হল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই হল কোথায়? এ তো দুর্নীতির কাছে আত্মসমর্পণ! নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন তো বিরাট স্বস্তি পেয়ে গেলেন। পার পেয়ে গেলেন। তাঁকে ইস্তফা দিতে হল না। শুধু বলা হল, গুরুনাথ কাণ্ডের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত শ্রীনিবাসন বোর্ডের কাজকর্ম দেখবেন না। আর যা-ই হোক, এই প্রহসনটা বিসিসিআই তথা ক্রিকেটের পক্ষে একেবারেই ভাল হল না।
অনেকে অবশ্য মনে করছেন, এ দিন পওয়ার গোষ্ঠীকে হারিয়ে জেটলি গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ নিল বোর্ডের। যদিও অরুণ জেটলি নিজেই সমালোচিত হলেন বোর্ড এবং তাঁর দল বিজেপি-র অন্দরে, প্রকাশ্যে শ্রীনিবাসনের বিরোধিতা না করায়। বোর্ডের কোনও কোনও সদস্য প্রশ্ন তুললেন, বৈঠকে না-এসে জেটলি ভিডিও কনফারেন্সে শৌখিন বক্তব্য রাখলেন কেন? যুগ্মসচিব অনুরাগ ঠাকুর যিনি বৈঠক ডেকেছিলেন, এলেন না তিনিও। বোর্ড সদস্যদের অনেকেরই মনে হল, এঁরা সামনে থেকে শ্রীনির বিরোধিতা করার সাহস দেখাতে পারলেন না। তাই কাজের অছিলায় দূরে রইলেন। রাজীব শুক্ল এলেও কোনও কথাই বললেন না। অনেকেরই প্রশ্ন, জেটলি যিনি কি না বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী পদের অন্যতম দাবিদার, তিনি কেন ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ শ্রীনির সামনে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকবেন? কেন তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করবেন না? যেখানে তাঁর পার্টি রেলমন্ত্রীর ভাগ্নে উৎকোচ নেওয়ায় রেলমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করে, সেখানে জেটলি কেন এ রকম সিঁটিয়ে থাকবেন? এই শিবিরের মতে, রবিবার শ্রীনিবাসনের বিরুদ্ধে খোলাখুলি যুদ্ধে নামার সুযোগ হাতছাড়া করে আখেরে ক্রিকেট রাজনীতিতে নিজের আসনটাই নড়বড়ে করে ফেললেন জেটলি। |
বৈঠক সেরে বেরোচ্ছেন শ্রীনিবাসন। চেন্নাইয়ে। ছবি: রয়টার্স |
জেটলি-পন্থীদের অবশ্য বক্তব্য, তাঁরা তো এটাই চেয়েছিলেন যে তদন্তের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শ্রীনি দূরে থাকুন। সেটাই তো হয়েছে। জেটলি শিবিরের কথায়, মিডিয়া এটাকে আপস বলছে কেন? এটাই তো চাওয়া হয়েছিল যে শ্রীনির একটা শর্তও আমরা মানব না। তা-ই তো হয়েছে। জেটলি গোষ্ঠীর আরও দাবি, জেটলি যেটা করতে চেয়েছিলেন, করতে পারলেন। শ্রীনিবাসনকে হঠিয়েই দিলেন বোর্ড থেকে। সবাই ধরেই নিচ্ছে তদন্তের কাজ সেপ্টেম্বরের আগে শেষ হবে না। এবং তদন্তে যদি তিনি নিরপরাধও প্রমাণিত হন, শ্রীনিকে নির্বাচনে আসতে হবে। এই মুহূর্তে তাঁকে সরানোর জন্য তিন চতুর্থাংশ গরিষ্ঠতার দরকার। নির্বাচনে সে দায়বদ্ধতা নেই। সেখানে ১৬-১৫ জিতলেও হবে। সুতরাং জেটলি গোষ্ঠী মনে করছে, শ্রীনি অতীত হয়েই গেলেন। নির্বাচনে তিনি আর জিততে পারবেন না। এর পাল্টা অনেকে বলছেন, রবিবারের সভার আগে ভাবা হয়েছিল, সব রথী-মহারথী একজোট হয়ে শ্রীনি-অপসারণে নামবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিরোধীরাই দু’ভাগ।এক দিকে পওয়ার-বিন্দ্রা-ললিত মোদী। অন্য দিকে ডালমিয়া আর জেটলি। এই কারণেই সেপ্টেম্বরের নির্বাচনটা কিন্তু জঙ্গি হতে পারে।
শ্রীনিবাসন তাঁর সরকারি বক্তব্যে বলেছেন, “আমি তদন্তের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসব না। ডালমিয়াই সব দেখাশোনা করবেন।” কোথাও বলেননি, ডালমিয়াই অন্তর্বর্তিকালীন সভাপতি। ডালমিয়া শিবির অবশ্য দাবি করছে, বৈঠকে সেটাই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা নিয়ে কোনও অনিশ্চয়তা নেই। আইএস বিন্দ্রা আবার বলেছেন, একই সঙ্গে দু’জন প্রেসিডেন্ট কী করে থাকতে পারে? যা শুনে উত্তেজিত ডালমিয়া শিবিরের বক্তব্য, দু’জন প্রেসিডেন্ট তো নেই। এক জন নিষ্ক্রিয়। আর এক জন কার্যনির্বাহী। তাঁরা বলছেন, বিন্দ্রা সভার বাইরে বেরিয়ে মিডিয়াকে অনেক কথা বলতে পারেন, কিন্তু সভার মধ্যে বিন্দ্রাই প্রস্তাব করেন দু’জন প্রেসিডেন্ট রাখা হোক। বলেন, “ডালমিয়াকে যদি প্রেসিডেন্ট করতেই হয়, তা হলে শশাঙ্ক মনোহরকেও রাখা উচিত।” মনোহর ছিলেন পওয়ার গোষ্ঠীর ক্যান্ডিডেট। বিন্দ্রা বারবার চাইছিলেন তিনি প্রেসিডেন্ট হোন। শেষ পর্যন্ত জেটলি গোষ্ঠীরই জয় হল। অবশ্য শ্রীনিবাসন যখন জেটলির নাম প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রস্তাব করেন, সেটাও আটকে দেন বিন্দ্রা।
ডালমিয়া রাতে চেন্নাই বিমানবন্দর থেকে আনন্দবাজার-কে বললেন, “বিন্দ্রা মিডিয়ায় কী বলছে, তাতে কান দিতে চাই না। আমি কড়া হাতে শুদ্ধকরণ অভিযানে নামব। হাতে হয়তো সময় কমই পাব। কিন্তু দায়িত্ব শেষ করার পর কেউ যেন না বলে, ফাইলগুলোয় ধুলো জমেছিল।”
বিন্দ্রা গোষ্ঠী আবার আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে যে, এই সভা বৈধ নয়। সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তও তাই অবৈধ। এখন দেখার, বিন্দ্রা সত্যিই স্থগিতাদেশ আনতে পারেন কি না। সে ক্ষেত্রে ডালমিয়ার প্রত্যাবর্তন পড়ে যাবে আবার আইনি জটিলতার মধ্যে। ডালমিয়া নিজে অবশ্য সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেন। তাঁর গোষ্ঠী পাল্টা বলছে, সভায় যোগ দিয়ে খাতায় সই করে আবার ‘বৈধ নয়’ কী?
রাতের দিকে আবার বিন্দ্রা-প্রসঙ্গে একটি চ্যানেলে জেটলি বলে দিলেন, “বিন্দ্রা কী বলেছেন, তার প্রতিক্রিয়া দিতে বাধ্য নই। আমি কলকাতাতেও শ্রীনিবাসনকে বলেছিলাম, যে হেতু ওঁর পরিবারের লোকের নাম এই কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে, তাই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত উনি সরে দাঁড়ান। আর রিমোট কন্ট্রোল শ্রীনিবাসনের হাতে থাকল বলে মিডিয়া যা বলছে, সম্পূর্ণ বাজে কথা। শ্রীনিবাসনের সরে দাঁড়ানো মানে বোর্ডের কোনও কাজে উনি আর থাকবেন না। পুরো প্রশাসন ওয়ার্কিং কমিটি দেখবে।”
কিন্তু বোর্ড মহলের কেউ কেউ আবার বলছেন, জেটলি বা ডালমিয়ার নাম অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেশ করাটাও শ্রীনিবাসনের স্ট্র্যাটেজিরই একটা অংশ ছিল। তিনটে ‘অপশন’ নিয়ে নাকি সভায় ঢুকেছিলেন শ্রীনিবাসন। এক, তিনি কোনও ভাবেই পদত্যাগ করবেন না। যা হওয়ার হবে নির্বাচনে। দুই, ঢুকেই পদত্যাগ করে সভা বাতিল করে দেবেন। আর তিন, নিজে সাময়িক সরে গিয়ে জেটলি বা ডালমিয়াকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট করে দেবেন। সদস্যদের ভাবগতিক দেখে তার পর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। সে কারণেই কি না জানা নেই, বৈঠকের পর সঞ্জয় জাগদালে থেকে অজয় শিরকে, কীর্তি আজাদ থেকে জয়বন্ত লেলে বিস্ফোরক। জাগদালে এবং শিরকেদু’জনেই জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা আর ফিরবেন না। বলে দিয়েছেন, বৈঠকে যা হয়েছে, তাতে ভারতের ক্রিকেটপ্রেমীদের বিশ্বাস ফিরবে না। কীর্তি আজাদ বলেছেন, “এর চেয়ে অযোগ্য প্রশাসন আর হয় না। নরেন্দ্র মোদীর মতো শক্ত লোক চাই বিসিসিআইয়ে।” আর বোর্ডের প্রাক্তন সচিব লেলের বিরক্তি, “যা ঘটল, তা দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছি। পুরো ব্যাপারটাই অবৈধ। কারণ ওয়ার্কিং কমিটি কাউকে কোনও পদে নির্বাচিত করতে পারে না। ম্যাচ ফিক্সিং কাণ্ডের সঙ্গেই এই বোর্ড মিটিংয়ের তুলনা টানা যায়। দু’টোতে কোনও তফাতই নেই।” প্রাক্তন নির্বাচক প্রধান কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তও বলছিলেন, “ক্রিকেট সমর্থকরাই এতে প্রতারিত হলেন।”
চেন্নাইয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে আদতে তা হলে কী হল? আদ্যন্ত লোকভোলানো একটা পর্ব নাকি আমূল শুদ্ধকরণের রাস্তায় চলার শুরু? নাকি রবিবাসরীয় চেন্নাই শুধুই দেখল অতীতের দুঁদে ক্রিকেট প্রশাসকের মহানাটকীয় প্রত্যাবর্তন?
রাতে দমদম বিমানবন্দরে আইসিসি-র প্রাক্তন বঙ্গজ মহাকর্তাকে ঘিরে সিএবি কর্তাদের ‘লং লিভ ডালমিয়া’ চিৎকার, ঝপাঝপ গলায় মালা পরানো, অসংখ্য ফুলের তোড়া দিয়ে রাজকীয় অভ্যর্থনা দেখলে মনে হবে শেষ ধারণাটাই বোধহয় বেশি প্রাসঙ্গিক। ‘...এই জয় আমার একার নয়... হাতে সময় বেশি নেই, তার মধ্যেই ক্রিকেটপ্রেমীদের বিশ্বাস ফেরাতে হবে... চেন্নাইয়ের বৈঠকে আজ কারও চোখে ধুলো দেওয়া হল বলে মনে করি না... আজ প্রমাণ হয়ে গেল আমি নির্দোষ ছিলাম...’ দরদরিয়ে ঘামতে ঘামতে কথাগুলো যখন বলে চলেন বোর্ডের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট, তখনও ছবি তোলার আব্দার। মিডিয়ার বুমের গুঁতোগুঁতি। তাঁর গাড়ির পিছু-পিছু ওবি ভ্যানের ধাওয়া করা।
বছর বারো-তেরো আগে ঠিক যেমন হতো! |