ইহাকে কি পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের পারস্পরিক ‘গাঁধীগিরি’ বলা চলে? আইন-অমান্যকারী বামপন্থীরা পুলিশের দিকে দুই হাত বাড়াইয়া কাতর অনুরোধ করিতেছেন, তাঁহাদের যেন গ্রেফতার করা হয়। আর ঢালতরোয়াল সজ্জিত পুলিশ লাঠি-চার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছোড়া, জল-কামান কিংবা রবার-বুলেট ব্যবহার দূরস্থান, কিছুতেই আন্দোলনকারীদের শ্রীঅঙ্গ স্পর্শ করিতেও অস্বীকৃত, পাছে তাঁহারা ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যান! রাজধানী কলিকাতার স্নায়ুকেন্দ্র শুক্রবার এই দৃশ্যই কয়েক ঘণ্টা ধরিয়া প্রত্যক্ষ করিল। যাঁহারা পরস্পরের বাপান্ত না করিয়া পারতপক্ষে জলগ্রহণ করেন না, সেই বিরোধী বামফ্রন্ট ও তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকার যে সংযম, সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক পৃষ্ঠকণ্ডূয়নের নমুনা দাখিল করিলেন, তাহা যদি দস্তুর হইয়া ওঠে, তবে অচিরেই শান্তি ও সমৃদ্ধির সোনার বাংলা গড়িয়া উঠিবে।
বাস্তবিকই শুক্রবার দ্বিপ্রহরের রানি রাসমণি রোড যেন এক অচেনা দ্বীপভূমি, যেখানে যুযুধান দুই পক্ষই ‘ভেরি ভেরি সরি মশলা খাবি?’ ‘ভাল ছেলে’ সাজার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। কমরেড বিমান বসুর স্পষ্টতই এই প্রতিযোগিতা পরিপাক হয় নাই। তিনি পুলিশের এই আস্ফালনবর্জিত শান্তি-পারাবতের ভূমিকায় নিজেদের পেশি-প্রদর্শনের সম্ভাবনা নাশ হওয়ায় রুষ্ট হইয়া গোটা ঘটনাটিকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়াছেন। প্রহসনটি হাস্যকর মাত্রায় পৌঁছায়, যখন আইন-অমান্যকারীরা তাঁহাদের গ্রেফতার করার দাবিতে উপস্থিত পুলিশ-কর্তাদের পীড়াপীড়ি করিতে থাকেন। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে আনিয়া পুলিশ যখন উপস্থিত সকল আইন-অমান্যকারীকে যুগপৎ গ্রেফতার ও নিঃশর্ত মুক্তির কথা ঘোষণা করে, তখনই বামফ্রন্ট সভাপতি গোটা ঘটনাটির প্রহসনময়তা উপলব্ধি করেন। প্রহসনই তো! কিন্তু প্রহসন কি নূতন হইল? এত কাল ধরিয়া আন্দোলনের নামে জনজীবন অচল করার যে অলীক কুনাট্য নিয়মিত রাজ্যবাসীকে উপহার দেওয়া হইয়াছে, তাহা কি নির্মম প্রহসন নহে?
মারমুখী না হইলে পুলিশকে ঠিক মানায় না, পুলিশের নিজেরই এমন ধারণা আছে। আবার আন্দোলনকারীদের যদি মাথাই না ফাটিল, রক্তপাত না হইল, তবে আর আন্দোলন করিয়া লাভ কী? অনেক দলকেই তাই দেখা যায়, পুলিশের গায়ের উপর নিজেদের কার্যত ছুড়িয়া দিতে, যাহাতে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ নিজেকে দুই হাতে আড়াল করিতে গেলেও দুই-একজন আন্দোলনকারী ধাক্কা খাইয়া ছিটকাইয়া পড়েন। শুক্রবারের আইন-অমান্য যে ইহার ব্যতিক্রম হইতে পারিল, তাহার নেপথ্যে রবিবারের হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের প্রভাব আছে। পাছে ব্যালটে ভোটদাতাদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয়, তাই উভয় পক্ষই যৎপরোনাস্তি সংযত থাকিয়াছে। এই সংযমের পাঠ লড়াই-খ্যাপা রাজনীতির কারবারিরা কত দিন অনুসরণ করিবেন তাহা অবশ্য কঠিন প্রশ্ন। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপত্র পেশকে ঘিরিয়াই গ্রাম-বাংলায় হিংসা ও নৈরাজ্যের সেই ট্র্যাডিশন দ্বিগুণ চলিতেছে। |