চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের ৯১তম জন্মদিন উপলক্ষে গৌতম ভট্টাচার্যের নেওয়া মৃণালবাবুর সাক্ষাৎকারের (পত্রিকা, ১১-৫) দু’একটি মন্তব্যে এবং জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেওয়া তার প্রতিক্রিয়া (পত্রিকা, ১৮-৫) সম্পর্কে একটু ক্ষোভ এই অধম বাঙালি অভিনেতার অন্তরে জন্ম নিয়েছিল। উত্তমকুমার সম্পর্কে মৃণালবাবুর মন্তব্যে যে ভাবে ‘নকল’ শব্দটি এসেছে বা মৃণালবাবুর ছাত্রসম অঞ্জন দত্তের উক্তিতে যে ভাবে মনে হয় উত্তমবাবু অসাধারণ অভিনয় করেছেন তাঁর মৃত্যুর মাত্র চার-পাঁচ বছর আগে, সে সব মেনে নেওয়া একটু কঠিন। কারণ অঞ্জনবাবু যে যে ছবিতে উত্তমবাবুকে নম্বর দিয়েছেন, সে সবই ওই সময়ের মধ্যে গৃহীত। কিন্তু ১৯৫৪ সালে নির্মল দে-র ‘চাঁপাডাঙার বউ’ ছবিতেই উত্তমবাবুর অভিনয় স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের চোখে পড়ে। দূরদর্শনে তিনি সে কথা কবুলও করেন। তার পর ১৯৫৯-এর ‘বিচারক’ দেখেছেন? ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’? ১৯৫৭-র ‘জীবনতৃষ্ণা’ ছবিতে দেখবেন তো অঞ্জনবাবু, উত্তম-ঠোঁটে লিপস্টিকের চেয়ে সিগারেটের পরিণত নিকোটিন ছোপ ফেলেছে কি না?
তবু চুপ করেই ছিলাম। কিন্তু সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদক সমীপেষু, ২৭-৫) মৃণালবাবুর মন্তব্যের সমর্থনে যে চিঠি দিলেন, তার প্রতিবাদ করাটা এক জন বাঙালি অভিনেতা হিসেবে কর্তব্য বলে মনে হল। |
সুমন্ত্রবাবু মৃণালবাবুর উত্তম-সম্পর্কিত মন্তব্যের প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রু রবিনসনকে দেওয়া সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ তুলে ধরেছেন। কিন্তু ঘটনা হল, সত্যজিৎ রায় তাঁর মন্তব্যে কোথাও উত্তমকুমারের অভিনয়-প্রতিভা নিয়ে কটাক্ষ করেননি। এবং এ বিষয়ে উন্নাসিকতাও তিনি পরে ত্যাগ করেছিলেন। এ বার উত্তমের জীবৎকালে প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘আমার আমি’ থেকে সত্যজিৎবাবুর উত্তমকুমার সম্পর্কিত ক’টি লাইন পেশ করা যাক। তিনি বলছেন, ‘উত্তমকুমার কোনও পরিচালকের ব্যক্তিগত সার্টিফিকেটের অপেক্ষা রাখেন না। তিনি যে বিশ বছর ধরে একশোরও বেশি ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে আজও জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থান অধিকার করে আছেন, এটাই তাঁর কৃতিত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এ জিনিস যে কেবল বরাতজোরে হয় না, এ বিশ্বাস আমার আগেই ছিল। আমি আশা করি তিনি আজ যে জায়গা দখল করে আছেন, সেখানে ঠিক এই ভাবেই আরও বহু দিন থাকবেন।’ উত্তম-প্রয়াণের পর দূরদর্শনে সম্প্রচারিত ‘নায়ক’ আবার দেখে বলেছিলেন, ‘আমার দু’একটা ত্রুটি নজরে এল কিন্তু উত্তমের অভিনয়ে একটা ভুলও ধরা গেল না।’
তা ছাড়া সবার উপরে ‘সময়’ সত্য। রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ রায়— সবাইকে এই সময়ের সামনে বিচারের প্রত্যাশায় দাঁড়াতে হয়। রবীন্দ্রনাথ তাই লেখেন—
‘আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে’।
সেই কালও তো উত্তমকুমারকে স্বীকৃতি জানিয়ে দিয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর তিন দশকের বেশি অতিক্রান্ত, তবু আজও তাঁর অভিনয় মানুষের আধুনিক মনে হয়। আজও তাঁর মৃত্যু-মাসে চ্যানেলগুলিতে উত্তম-ছবিই দেখানো হয়। উত্তমবাবুর জন্য নয়, টিআরপি-র কারণে। মানুষ চায় বলে। তবুও এত উত্তম-স্পর্শকাতরতা কেন?
সারা ভারত জুড়ে কি আজও পাওয়া যাবে এমন এক জন অভিনেতা, যিনি ইংরেজি ভাষায় স্নাত নন, শেলি, কিট্স, বায়রন পড়েননি অথচ উৎপল দত্তের ওথেলোর ওই উচ্চারণ নিজের ঈষৎ পুরু জিভে কী দক্ষতায় আর নিষ্ঠায় তুলে নিয়েছিলেন? উৎপলবাবু পরিচালক অজয় কর-কে বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, ‘আর ছ’টা মাস সময় দিন। উত্তম নিজের কণ্ঠে নিজের উচ্চারণে শেক্সপিয়র পড়বে।’
একটু ভাববেন স্যর। তিনি না-ই বা হলেন সুনীল-শক্তি-মতি’র বন্ধু। নাই বা পড়লেন এম এ। নাই বা কফি হাউসে বসে আওড়াতে পারলেন ত্রুফো-গোদার-ফেলিনি। আসুন, আগে ভবানীপুরের নিম্নমধ্যবিত্ত অতি সাধারণ এক বাঙালির এই মাধ্যাকর্ষণ তৈরির তপস্যাকে একটা প্রণাম জানাই। ঘনিষ্ঠ আড্ডায় সৌমিত্রবাবুর কাছে কেউ উত্তম-সমালোচনা করে পার পেয়ে যান না। কানে হাত দিয়ে পরম শ্রদ্ধেয় মৃণালবাবুকেও বলছি, উত্তমকুমারের ছবি একটু দেখুন প্লিজ।
সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা-৩
|
মৃত্যু, জীবনের নিয়তি। নিজের মানুষকে হারালে, দুঃখে, শোকে, বিমর্ষে মানুষ মর্মাহত হয়, স্বাভাবিক। জীবনে এই দুঃখ, অসহ্য বিরহ বহু বার অনুভব করেছি কঠিন ভাবে, নীরবে। কিন্তু স্মৃতি খুবই ক্ষণস্থায়ী। জীবনধারার জোয়ারে মৃত্যুর শোক কোথায় যেন ডুবে যায়।
আশ্চর্য, ঋতুপর্ণ ঘোষের অকালমৃত্যু আমার মতন এক জন তথাকথিত বিজ্ঞানীর মনে গভীর ভাবে আঘাত করেছে। মর্মাহত হয়েছি।
মানুষটি ছিলেন সত্যের পূজারি, সেই হিসেবে আমরাও। সমাজের সংসারের দ্বন্দ্ব নিয়ে ঋতু যে ছবি তুলে ধরেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে এক অস্বাভাবিক প্রতিভার পরিচয়। সে ছবি দেখলে সত্যের তেজে, মানুষ ঝলসে যায়।
ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ খুব নিকট ছিল না, আমি আপনি বলে সম্বোধন করলে, আড়ষ্ট হতেন। মানুষটির বয়স কম, কিন্তু ভদ্র, নম্র, প্রায়ই লজ্জিত। ওঁর সমসাময়িকরা আমার ছাত্র, যাদবপুরের পণ্য।
মানুষটির চোখের চাহনি দেখেই বোঝা যায় যে তিনি সমাজকে নতুন ভাবে দেখতে চান, উপলব্ধি করতে চান, সত্যের ভিত্তিতে, অকপটে।
তিনি ছিলেন প্রতিভার শিখরে, প্রতিভা পরিপূর্ণ হওয়ার আগেই দিয়া গেল নিভে।
বিজ্ঞান মানুষেরই সৃষ্টি। আবিষ্কারের বিচিত্রতা, বাস্তবের সীমাহীন সৌন্দর্য আবিষ্কারের নেশা ঋতুকেও চেপে ধরেছিল— সেই জন্যই বোধহয় আমরা শেষ বিচারে এক রাস্তার পথিক, আর তাই বোধহয় এই অকালপ্রয়াণে এতখানি দুঃখ। দুঃখ যেন জ্বলছে! এ প্রদীপ মনের ভেতরে থাকবে, বেশ কিছু দিন।
বিকাশ সিংহ। কলকাতা-২০ |