অবশেষে মায়ানমারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী আঙ সান সু চি রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি সংঘটিত অন্যায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুখ খুলিলেন। গত বছর রাখিনে প্রদেশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ বর্মনদের গণহত্যার (যাহাতে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত এবং দুই লক্ষাধিক উদ্বাস্তু হন) সময় সু চি মুখে কুলুপ আঁটিয়াছিলেন। এই সমস্যা সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নের জবাবও দিতে চাহেন নাই। যেন দেশে বসবাসকারী আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মানুষের মতো বাঁচার অধিকারই নাই। কাচিন ও কারেন জনগোষ্ঠীর প্রতি ঘটিতে থাকা বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি মুখর হন, ‘মন’, ‘শান’ ও ‘চিন’ জনজাতির উপর সরকারি দমননীতির নিন্দা করেন, কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব পর্যন্ত না দেওয়ার অমানবিকতার বিরুদ্ধে রা কাড়েন নাই। তবে ভোট বড় বালাই। জাতীয় পার্লামেন্টের উপনির্বাচনে তাঁহার দল যে চমকপ্রদ সাফল্য পাইয়াছে, ২০১৫ সালে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে তাহা ধরিয়া রাখিতে পারিলে সু চি-ই হইবেন মায়ানমারের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। তাই রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদেও তাঁহাকে মুখর হইতে হইল। এই প্রতিবাদ আরও জরুরি এই কারণে যে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আবার নূতন করিয়া বৌদ্ধ বর্মনরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের বসতি ও ধর্মস্থানের উপর আক্রমণ শানাইতেছে।
মায়ানমার এখনও ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে। প্রাক্তন জেনারেল থাইন সেইন-এর শাসন ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরাইয়া দিতে সচেষ্ট হইয়াছে ঠিকই। রাজনৈতিক বন্দিরা মুক্তি পাইয়াছেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরাইয়া দেওয়া হইয়াছে, আত্মশাসনের দাবিতে সংগ্রামরত কিছু কিছু জনজাতীয় গোষ্ঠীর সহিত আপস-রফার প্রক্রিয়াও চলিতেছে, ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ রদ করিয়া বেসরকারি ব্যক্তিমালিকানাধীন ও কর্পোরেট পুঁজির বিনিয়োগ ছাড়পত্র পাইতেছে। গণতান্ত্রিক সংস্কারের এই প্রক্রিয়াই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ইয়াঙ্গনের বিরুদ্ধে এতাবৎকাল জারি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রদ করিতে প্ররোচিত করিয়াছে, তাহাও নিশ্চিত। ইহার ফলে চিনের উপর দেশটির ঐকান্তিক নির্ভরশীলতাও কমিতেছে। প্রযুক্তি ও পুঁজির জন্য মায়ানমারের শাসকরা পশ্চিমাস্য হইয়াছেন। কিন্তু মায়ানমারকে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অঙ্গীভূত করিয়া লইতে গেলে সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কার ত্বরান্বিত হওয়া জরুরি। এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন কাচিন, চিন, মন, শান, কারেন প্রভৃতি জনজাতীয় গোষ্ঠীর সহিত সংখ্যাগরিষ্ঠ ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বর্মনদের বোঝাপড়া। সমানাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রান্তিক এলাকাগুলিতে পূর্ণাঙ্গ অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি শিরোধার্য করিয়া সু চি-র প্রয়াত স্বামী জেনারেল আঙ সান ১৯৪৭ সালেই যে চুক্তি সম্পাদন করিয়াছিলেন, সেই প্যাংলং চুক্তির পুনরুজ্জীবনই জাতিবৈর-বিড়ম্বিত মায়ানমারকে সংহত রাখিতে পারে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব প্রদানও সাম্যভাবনার অঙ্গ। অথচ ১৯৯৪ সালের এক আইন জিয়াইয়া তুলিয়া মাউংদং জেলার কর্তৃপক্ষ ফতোয়া দিয়াছে, রোহিঙ্গা দম্পতিরা দুইটির অধিক সন্তান প্রজনন করিতে পারিবে না। সাধারণ ভাবে জনবিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণের নীতি রূপে সকল জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এই ধরনের নিয়ম চালু করার পরিবর্তে কেবল মুসলিম রোহিঙ্গাদের বেলায় ইহার প্রয়োগ নিতান্তই স্বৈরাচারী দমন নীতি। তাহার বিরুদ্ধেই সু চি অবশেষে সরব।
মায়ানমারের ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব’-এর সহিত ‘আরব বসন্ত’র তফাত হইল, এই বিপ্লব উপর হইতে নীচে নামিতেছে। পরিবর্তনের দাবি পশ্চিম এশিয়ার সামরিক স্বৈরতন্ত্রগুলির মতো মায়ানমারেও ছিল, কিন্তু সেই দাবিতে তৃণমূল স্তরের জনসাধারণ বিদ্রোহে ফাটিয়া পড়েন নাই, যেমনটা টিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিশর কিংবা ইয়েমেনে ঘটিয়াছে। পরিবর্তে দেখা গিয়াছে সামরিক শাসকরা নিজেরাই উদ্যোগী হইয়া জনসাধারণের জন্য ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক অধিকার মঞ্জুর করিতেছেন। এই ধরনের ‘বিপ্লব’ সাধারণত অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়, প্রায়শ মধ্যপথে পরিত্যক্ত হয়, উদারনৈতিক ও সহৃদয় স্বৈরাচারীরা ক্লান্ত হইয়া পড়িলে জনকল্যাণের ব্রত বিসর্জিত হয়। মায়ানমারে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা তাই সাংবিধানিক পরিবর্তনসাপেক্ষ। |