সকাল সাড়ে ন’টার ইএম বাইপাস। আর পাঁচটা রবিবারের মতো কিছুটা অলস মেজাজে।
কিন্তু পাশের রাস্তা ধরে একটা সাদা স্করপিওকে আসতে দেখে আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু লোকের মধ্যে যেন হঠাৎ চাঞ্চল্য! হুড়মুড়িয়ে স্টার্ট নিল কয়েকটা গাড়ি। স্করপিও বাইপাসে ওঠার আগেই একটা টাটা সুমো গিয়ে পথ আটকাল। পিছনেও ততক্ষণে হাজির একটা কোয়ালিস। শেষে এল আর একটা সুমো। তা থেকে কয়েক জন নেমে দৌড়ে গিয়ে ফাঁদে পড়া গাড়ির দরজা খুললেন। টেনে-হিঁচড়ে নামানো হল সামনের সিটে বসে থাকা নীল-সাদা চেক শার্ট, কালো প্যান্টের এক যুবককে। মুহূর্তে তাঁকে সুমোয় তুলে ওঁরা মিলিয়েও গেলেন। |
ছবিতে বুম্বার সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামল মণ্ডলকে। যদিও
শ্যামলবাবুর দাবি, সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর কোনও সংস্রব ছিল না।—ফাইল চিত্র |
সিনেমার শ্যুটিং? আচমকা দেখলে তা-ই মনে হতে পারে। যদিও তা নয়। বাস্তবে এ ভাবেই এ দিন সকালে বাইপাস লাগোয়া মুকুন্দপুরে পুলিশের ঝটিতি অভিযানে গ্রেফতার হলেন সারদা-কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত সংস্থার বারুইপুরের ডিভিশনাল ম্যানেজার অরিন্দম দাস ওরফে বুম্বা। চল্লিশ দিন ফেরার থাকার পরে।
পুলিশ-সূত্রের খবর: ব্যবসায় ভরাডুবির জন্য আরও অনেকের সঙ্গে বুম্বার দিকে একাধিক বার আঙুল তুলেছেন সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। পুলিশি জেরার মুখে যাঁর দাবি, শাসকদলের নেতাদের একাংশের মদতের জোরে সারদার বারুইপুর অফিসে বুম্বা আধিপত্য কায়েম করেছিলেন, আমানতের কোটি কোটি টাকার পাশাপাশি হাতিয়ে নিয়েছিলেন একাধিক জমি। বস্তুত এককালের অটোচালক ওই যুবক বারুইপুরের সারদা-ম্যানেজার পদে বসার পর থেকে যে দু’হাতে টাকা ওড়াচ্ছিলেন, স্থানীয় মানুষের মুখেও তা জানা গিয়েছে। তাঁর টালির ছাদের ঘর রাতারাতি চোখ ধাঁধানো অট্টালিকায় রূপান্তরিত হয়, এমনকী স্নানঘরেও এসি বসানো হয়েছিল!
এ হেন বুম্বার নামে গত ২২ এপ্রিল বারুইপুর থানায় প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেছিলেন মানিক চক্রবর্তী নামে সারদার এক এজেন্ট ও শ’তিনেক আমানতকারী। তার ভিত্তিতে পুলিশ বুম্বার বাড়িতে হানা দিয়েও তাঁর নাগাল পায়নি। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, “তত দিনে ও টের পেয়ে গিয়েছিল যে, ব্যবসা ডুবেছে। তাই নালিশ দায়ের হওয়ার আগেই এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দেয়।” ধরা পড়লেন কী ভাবে? পুলিশ-সূত্রের দাবি, ফেরার হওয়া ইস্তক বুম্বা নিজের মোবাইল ফোন বন্ধ রাখলেও অন্য মোবাইল মারফত বারুইপুরের কয়েক জন ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। সেই সব ফোনের সূত্র ধরেই তাঁর গতিবিধির হদিস মিলছিল। কী রকম? |
আদালতের পথে বুম্বা।-নিজস্ব চিত্র |
তদন্তকারী-সূত্রের খবর: ২১ এপ্রিল বাড়ি থেকে বেরিয়ে বুম্বা প্রথমে যোধপুর পার্কে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। দিন তিনেক সেখানে কাটিয়ে চলে যান বনগাঁয়, শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে দু’দিন থেকে সোজা দার্জিলিং। সেই ২৭ এপ্রিল থেকে প্রায় এক মাস পাহাড়েই ঘাঁটি গেড়ে ছিলেন বুম্বা। ২৮ তারিখ সমতলে নেমে উত্তর ২৪ পরগনার হাবরায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠেন। গত শুক্রবার তিনি মকুন্দপুরের ভেড়ি এলাকায় এসে ডেরা বাঁধেন।
এবং হাতের নাগালে এসে যাওয়ার পরেই পুলিশ তাঁকে পাকড়াও করার ছক কষতে থাকে। চেষ্টা চলতে থাকে ভেড়ির ডেরা থেকে তাঁকে বার করে আনার। এক পুলিশ-কর্তা জানাচ্ছেন, “এ জন্য আমরা একটা কৌশল নিয়েছিলাম। পুলিশ যে ওর খোঁজ পেয়ে গিয়েছে, এবং যখন-তখন হানা দিতে পারে, সে কথাটা চর মারফত ওর কানে পৌঁছে দেওয়া হয়।” কর্তাটির দাবি, সেই খবর পেয়েই বুম্বা পালানোর মতলব আঁটেন। আর তা করতে গিয়েই এ দিন ফাঁদে পড়েন।
কী ভাবে?
জেলা পুলিশ-সূত্রের বক্তব্য: বুম্বা ফের উত্তরবঙ্গে পালানোর তালে ছিলেন। মুকুন্দপুরের আস্তানা থেকে কোন কোন রাস্তা ধরে তিনি এগোতে পারেন, পুলিশ তা ছকে নেয়। সেই অনুযায়ী জাল বিছানো হয় শনিবার শেষ রাতে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার অতিরিক্ত এসপি কঙ্করপ্রসাদ বারুইয়ের নেতৃত্বে পুলিশের দল বাইপাসের পুরো তল্লাটটি চার দিক দিয়ে ফেলে। সকাল সাড়ে ন’টায় মুকুন্দপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালের সামনে ত্রিমুখী হানায় বুম্বাকে পাকড়াও করা হয় প্রায় ফিল্মি কায়দায়। “এ যেন গর্ত থেকে ইঁদুর বার করে আনা! এক দিকে ধোঁয়া ঢুকিয়ে অন্য দিকে কল পেতে রাখা। গর্ত ছেড়ে বেরোতে গেলে ধরা তো পড়বেই!” মন্তব্য এক পুলিশ-কর্তার। বুম্বাকে গ্রেফতার করে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় সোনারপুর গ্রামীণ হাসপাতালে। সেখানে ডাক্তারি পরীক্ষা সেরে বেলা এগারোটা নাগাদ বারুইপুর মহকুমা আদালতে। দেখা যায়, কোর্ট লক-আপে অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন বুম্বা, গালে ক’দিনের না-কামানো দাড়ি। মা দীপা দাস ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। দীপাদেবী পরে বলেন, “মাসখানেক যাবৎ ওর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। এর মধ্যে আমানতকারীরা ক’বার এসে বাড়িতে চড়াও হয়েছে, টাকা না-পেয়ে অনেক কিছু লুঠ করে নিয়ে গিয়েছে।” কোর্টে এ দিন বুম্বার আইনজীবীরা জামিনের জন্য সওয়াল করেননি। পুলিশের আর্জির ভিত্তিতে বিচারক তাঁকে ১৪ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখতে বলেন।
সেই মতো বুম্বাকে নিয়ে যাওয়া হয় সোনারপুর থানার লক-আপে। সেখানে তাঁকে জেরা করেন তদন্তকারীরা। পুলিশের দাবি: দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে মুকুন্দপুরের ভেড়ি অঞ্চলে বুম্বার জন্য আশ্রয়ের বন্দোবস্ত হয়েছিল। বারুইপুরে জমি কেনা-বেচায় ওই নেতারাই বুম্বার সহযোগী ছিলেন বলে অভিযোগ। “বুম্বা হামেশা এজেন্ট-আমানতকারীদের নিয়ে অফিসে নানা অনুষ্ঠান করত। তাতে ছোট-বড় অনেক নেতা হাজির থাকতেন।” বলেন এক পুলিশ-কর্তা। তদন্তকারী-সূত্রের দাবি: বুম্বার সঙ্গে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা তৃণমূলনেতা শ্যামল মণ্ডলের সম্পর্ক সংক্রান্ত কিছু তথ্যও হাতে এসেছে। যদিও শ্যামলবাবু এ দিন বলেছেন, “আমার সঙ্গে বুম্বার কোনও সম্পর্ক ছিল না। আমি সারদার অফিসের ধারে-কাছে ঘেঁষতাম না।”
সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত ইতিমধ্যে অভিযোগ করে রেখেছেন যে, বেশ ক’মাস ধরে বুম্বা বারুইপুরের ডিভিশনাল অফিসে সংগৃহীত আমানতের টাকা সদরে তো পাঠাচ্ছিলেনই না, উল্টে ফেঁদে বসেছিলেন নিজস্ব অর্থলগ্নি কারবার। পুলিশ-সূত্রের খবর, এ দিন জেরায় সেই অভিযোগ বুম্বা মানতে চাননি। তাঁর দাবি: শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মাসে-মাসে সাড়ে তিন কোটি টাকার আমানত সদর অফিসে জমা করে গিয়েছেন। এ দিন বুম্বা পুলিশের হাতে চোদ্দো পাতার একটা রিপোর্টও তুলে দিয়েছেন। কী আছে তাতে?
এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “রিপোর্টে বুম্বার দাবি, সারদার সফ্টওয়্যার জালিয়াতি নিয়ে সুদীপ্ত সেনের অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যে।”
|